শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

শিরোনাম

কবিতা: প্রদাহ । সুজাতা

শনিবার, মে ২৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

সেদিন গাড়িতে যেতে যেতেই দেখলাম আমি হঠাৎ…..
একটি মেয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে,
বুঝলাম ব্যথায় সে যে কুপোকাৎ …!!
ভাবলাম দেরি হবে বটে,
তবুও বাস থেকে একটু নামি….,
কিন্তু পারলাম না…।

উপার্জনক্ষেত্রে সময়টা যে ভীষণই দামী।।
যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যথারীতি কর্মক্ষেত্রে মগ্ন হলাম।
ব্যথায় কাতরানো সেই মেয়েটির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
বিরতিতে যথারীতি চা-বিস্কিট খেলাম…
বেশ আয়েস করে পানটাও চিবোলাম।

ক্ষাণিকক্ষণ বাদে মনে হল,
জঠরে কেউ কোপ মারল।
এক বার দুই বার নয়, কোপ পড়ল বারংবার।

প্রথমে উফ্ করলাম , তারপর আহঃ করলাম,
এরপর শুরু করলাম চিৎকার।।
দৌড়ে এসে কেউ ঠান্ডা পানীয় দিল,
কেউ দিল সোডা, কেউ বা অ্যান্টাসিড।
কেউ খাওয়ালেন ডাবের জল,
কেউ গায়ে চড়ালেন বেডশিট।

কিন্তু কেউ পারল না সেই যন্ত্রণাকে দমাতে।
কেউ পারল না আমার চিৎকারটা থামাতে।
বস্ এলেন কেবিনে, – বললেন,
ওনাকে শিগগির নিয়ে চলুন।
আমার কর্মীদের চিকিৎসা বীমা করা আছে,
অমুক হাসপাতালে গিয়ে শুধু আমার কথা বলুন।

হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এল।
স্ট্রেচারে আমায় নিয়ে চলল।
পঞ্চাশ কেজির এক মহিলাকে একজন অনায়াসেই ওঠাতে পারে।
কিন্তু আমায় একাধিক জন ওঠালেন তাদের তর্জনীতে বিশাল ভার বহন করে।
হাসপাতালের সিঁড়িতে উঠতেই গন্ধ পেলাম বিভিন্ন রকমের।
আস্তে আস্তে স্ট্রেচারে যতই উপরে উঠছি, পরিবর্তন হচ্ছে স্যানিটাইজারের সুগন্ধের।
স্ট্রাইপ চাদর আর বালিশের বিছানা, ঝাঁ চকচকে রুম, বিভিন্ন আকার উন্নত সব যন্ত্রপাতির।

বুঝলাম ভালই পাব পরিষেবা, ভালই হবে যত্ন খাতির।
নিডল ফুটল শিরায়, শিওরের পাশে ঝুলল স্যালাইন।
জঠরে তখনও প্রদাহ বিক্ষোভে অমান্য চিকিৎসার আইন।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর নিশ্বাসের বাতাসেও তাই শীতলতা।
বুঝলাম প্রদাহ সামান্য লাঘব হচ্ছে, নয়নেও এল নিস্তেজতা।

জ্ঞান যখন ফিরল তখন রাত অগভীর।
সামান্য ঊষার আলো বাইরে, তবে নৈশ সেবিকার চোখে তখনও ঘুম অতি গভীর।
আস্তে আস্তে প্রকাশ এল, করিডরে চাপা কোলাহল নিয়ে নতুন দিন শুরু হল।

ডিসচার্জ পেয়েই প্রথমে বিল দেখলাম।
মনে মনে হাসলাম, ভাগ্যিস চিকিৎসা বীমাটা করিয়েছিলাম।

বাড়ি ফেরার পথে মনে পড়ল হঠাৎই ,
বেমালুম ভুলে যাওয়া সেই কাতরানো মেয়েটির মুখটি।
ঘরে ঢুকে স্নান করে, যৎসামান্য আহারও করলাম ভয়ে ভয়ে।
আবার যদি ব্যথা হয়,
সবাই আবার ব্যতিব্যস্ত হবে আমায় নিয়ে।।

অস্থির একটা মনঃস্থিতি নিয়ে দিন তিনেক পর হাঁটতে হাঁটতে চললাম মসজিদ পাড়া….।
যদি মেয়েটার কোন খোঁজ পাই,
জানি না এখন কোথায় যে আছে সেই বাস্তুহারা।
— না। তাকে পেলাম না।
পাশের এক দোকানদার দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি দেখেছেন কিনা!
তিনি বললেন, – আরে এমন কত শত অভুক্ত থাকে রাস্তায়,
অসুখে নয় এরা কাতরায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় !!
তিন দিন তার পেটে পড়েছিল না দানা।
সাত দিন দিন আগে ক্ষুধার জ্বালায় মরেছে তার তিন বছরের ছানা।
সেওতো মরত, ভাগ্যিস সরস্বতী পূজোটা ছিল।
কারোর হাত থেকে একটা খিচুড়ির থলে ফেটে রাস্তায় পড়েছিল।
পাগলীর কপাল ভাল,
সরীসৃপের মত দেহটা টেনে হিচড়ে মুখটা খিচুড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখার মত চোখের জল রুখেছিলাম….!!
বাকরুদ্ধ হয়ে উল্টোপথে স্টেশনের দিকে হেঁটেছিলাম।

কাজে যাবার সময় প্রতিদিন কত শত অসহায়দের দেখি।
কিছুই করি না, শুধুই সাদা কাগজে সামান্যই লেখালেখি।
কোথাও একটা প্রচলিত কথা শুনেছিলাম।
মানুষ দিলে কুলোয় না, ঠাকুর দিলে ফুরোয় না।

তবে আজ মনে হয় মানুষরূপী দেবতারা আসুক একটু অন্নসত্র নিয়ে।
অভুক্ত কাঙালেরাও বাঁচুক একটু পেটে অন্ন দিয়ে।

সেদিনের করুণ সেই ঘটনাচিত্র বিঁধে আছে হৃদয় ঝিল্লির প্রতিটি কোনায়।
তাই হয়তো আজও আমি ভাত মুখে দিলে, তাতে ধুলোর গন্ধ পাই।।
প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি বোঝায় আমায়,
স্বভাব বা ভাগ্য কেনটাই সবার একই রকম নয়।
কেউ অল্পতেই কাতর হয়,
কেউ অধিকেও পাথর রয়।
কিছু কষ্ট যেমন সহন করতে হয়,
কিছু কষ্ট তেমনই নির্লিপ্ততায় বহনও করতে হয়।