শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

আদর্শিক রাজনীতির ধ্রুবতারা অলি আহাদ

বুধবার, অক্টোবর ১৯, ২০২২

প্রিন্ট করুন

সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি: অলি আহাদের মৃত্যু বার্ষিকী ২০ অক্টোবর। ২০১২ সালের এ ২০ অক্টোবর সকালে তিনি ঢাকায় একটি হাসপাতালে মারা যান। অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। মেধাবী ছাত্র অলি আহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকমে ফাস্টর্ ক্লাস ফাস্টর্ হন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেয়ায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয় এবং তিনি এমকম ডিগ্রী লাভ থেকে বঞ্চিত হন। তার লেখা বই ‘জাতীয় রাজনীতি ৪৫-৭৫’ ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। কর্ম জীবনে তিনি ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তার স্ত্রী রাশিদা বেগম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রথম মহিলা মহা পরিচালক ছিলেন। তার একমাত্র কন্যা রুমিন ফারহানা বিএনপির সাংসদ ও আলোচিত টকশো ব্যক্তিত্ব।

১৯৪৬ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে অলি আহাদের রাজনীতিতে আগমন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সদস্যের বাইরেও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ঢাকা মহানগরের আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনের সময় সচিবালয় এলাকা থেকে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে ছিলেন। এ দেশের যুব আন্দোলনের সূচনা করেন অলি আহাদ। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মহানায়ক অলি আহাদ। ৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যে চার জন ভোট দেন, অলি আহাদ তাদের অন্যতম। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেফতার হন। দীর্ঘ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পেলেও গ্রামের বাড়িতে অন্তরীন করে রাখা হয়। ১৯৫৩ সালের সম্মেলনে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় তিনি নির্বাচন করতে পারেন নি।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে অলি আহাদ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অনুসৃত নীতির প্রতি সমর্থনের অপরাধে তিনি দল থেকে বহিস্কৃত হন। তার বহিস্কারের প্রতিবাদে আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির নয়জন সদস্য পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিষ্ঠা হলে অলি আহাদ তাঁর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনামলে চার বছর কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এনডিএফের অন্যতম নেতা অলি আহাদ। ১৯৬৯ সালে তিনি জাতীয় লীগ প্রতিষ্ঠা করে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাঙলা জাতীয় লীগ গঠন করেন। ১৯৭২-৭৫ সরকারের বিরুদ্ধে অলি আহাদের আজাদ বাঙলা আন্দোলন আধিপত্যবাদী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন তিনি গ্রেফতার হন ও ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। তিনি এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। এরশাদ আমলে তিনি আট বার কারাবরণ করেন। মৃত্যুকালে অলি আহাদ ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি ছিলেন।

১৯৭৩ সালের ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে অলি আহাদের সাথে আমার পরিচয় হয়। রাজনীতিতে লেখাপড়ার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দেশের পত্র-পত্রিকার বাইরেও বিদেশী পত্রিকা পড়তেন। তার কর্মী-সহকমীর্দের পড়তে বলতেন। তিনি মিথ্যা কথা বলতেন না, মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করতেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হরতালের দিন তিনি কখনো আলু সিদ্ধ বা সাধারণ মানের পাতলা খিচুরী সকলের সাথে খেতেন। হরতালের দিনে কখনো তিনি হরতালের সময় শেষ হওয়ার এক মিনিট আগেও রিক্সায় চড়তেন না।

আদর্শিক রাজনীতির ধ্রুবতারা অলি আহাদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার রাজনৈতিক আদর্শ ও নির্দেশনা আমাদেরকে সুস্থ্য রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগায়। অলি আহাদের ধ্যান-ধারণার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র ও জনগনের রাজনীতি বিকাশ লাভ করবে। আল্লাহ অলি আহাদকে জান্নাতবাসী করুন।