সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: বঙ্গবন্ধুর সহচর একেএম আবদুল মন্নান ছিলেন একজন রাজনীতির আদর্শ। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর কালে চট্টগ্রামে যে কয়জন বিখ্যাত নেতা ছিলেন, তার মধ্যে একেএম আবদুল মন্নান কিংবদন্তী রাজনীতিক। যিনি কখনো নিজের চিন্তা করেননি। লোভ-লালসা, আরাম-আয়েশ, প্রভাব-প্রতিপত্তির চিন্তা করেননি। দেশ ও জাতির মহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সারাটা জীবন রাজনীতি করেছেন। যে কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও সহচর এবং গণ-মানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত হন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-মেধা, দুরদৃষ্টি-গভীর প্রজ্ঞা, সাহস-দেশপ্রেম, ত্যাগ-সার্বজনীনতা, যোগ্যতা ও অসাম্প্রদায়িকতা যাকে করেছে বরণীয়-স্মরণীয়। মৃদু ভাষী ও সদালাপি একেএম আবদুল মন্নান আদর্শ রাজনীতিক ও রাজনীতির আদর্শ। যিনি নিজের জন্য নয়; দেশের জন্য, দশের জন্য ও রাজনীতির জন্য রাজনীতি করেছেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-মেধা, দুরদৃষ্টি-গভীর প্রজ্ঞা, সাহস-দেশপ্রেম, ত্যাগ-সার্বজনীনতা, যোগ্যতা ও অসাম্প্রদায়িকতা যাকে করেছে বরণীয়-স্মরণীয়। জাতি গঠনে তার ভূমিকা বা অবদান কম নয়।
একেএম আবদুল মন্নান সব সময় দেশের উন্নয়ন ও পরের জন্য কাজ করেছেন। অন্যায়, অত্যাচার ও অপরাধের প্রতিবাদ করতেন। নিজের সুখ ও সম্পদ সকলের জন্য উৎসর্গ করতেন। শৃঙ্খলবন্দী পরাধীন দেশ ও দেশবাসীর কথা চিন্তা করে এক সময় নিজেকে রাজনীতির সাথে জড়ালেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থ্যানসহ সব আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সম্মুখভাগে থাকতেন। এমনকি ভাষা আন্দোলনেও তার অংশগ্রহণ ছিল। দেশ গড়ার কাজে ছিলেন অবিচল। যতই বাধা আসুক, কখনো তিনি পিছপা হননি। সব প্রতিকূলতা সাহস ও তীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে মোকাবেলা করতেন। তিনি আরো উদ্দীপ্ত হন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি মুক্তি সংগ্রামে জনমত গড়ে তোলেন। তার দেশপ্রেম, ত্যাগ, সাহসিকতা ও রাজনৈতিক মেধার কারণে দেশদ্রোহীদের রোষানলে পড়েন। যুদ্ধ চলাকালে তার বসত ঘর পুড়িয়ে দেশশত্রুরা পাশবিক উল্লাস করে। যুদ্ধে আর্থিক, আত্মিক, সাময়িক, সামরিক, কায়িক, কাব্যিক, যৌক্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিকসহ বিভিন্নভাবে গণমানুষকে জাগিয়ে তোলেন। জীবন বাজি রেখে মুক্তিপাগল মানুষদের সাথে নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধসহ সবকিছুতে তিনি সফল ও উপমেয়।
একেএম আবদুল মন্নান সমৃদ্ধ ও আলোকিত জাতি গড়ার জন্য রাজনীতি করেছেন। গরীব ও অসহায়দের অর্থ বা পরামর্শ যখন যা প্রয়োজন, তা দিতে চেয়েছেন। তিনি অসহায়বান্ধব হলেও বিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করতেন না। তাই, তিনি কর্মসংস্থান বা আয়বর্ধক কাজে গরীবদের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিশেষ করে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ, কুঠির শিল্প ও কারিগরি শিক্ষায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন। যোগাযোগসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, হাট-বাজার আধুনিকীকরণ, জন্মস্থান বরমার ডাকঘরের ভৌতঅবকাঠামো উন্নয়ন, বরমা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ২০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীতকরণ, বরমা কলেজ প্রতিষ্ঠা, পাবলিক পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যারিস্টার যাত্রামোহন সেনগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত বরমা ত্রাহিমেনকা উচ্চ বিদ্যালয় উন্নয়ন, বরমা মাদরাসা উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা দপ্তরে যোগাযোগ করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে নিজ মাতৃভূমি বরমাতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ৭৫এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জাতির অন্যান্য স্বপ্নের সাথে তার স্বপ্নেও ভাটা পরে। পরবর্তী ১৯৮৪ইং সালে আবার তিনি অন্যান্যদের সাথে বরমা কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। বরমা কলেজের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বরমা কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা কমিটির (প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির বা প্রথম কমিটির) সভাপতি ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রজাতন্ত্রের কাছে অস্ত্র সমর্পন করেন প্রথম দিকে। মুক্ত বাংলাদেশকে সুখী-স্বনির্ভর রাষ্ট্র গড়তে সরকার প্রধানকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতেন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, সেনা অফিসার হত্যা, রাজাকারদের পুনর্বাসন ও কর্তৃত্ব তার মন ক্ষত বিব্রত হয়ে যায়। স্বপ্নচারী মন্নান এক সময় স্বস্তি হারিয়ে ফেলেন, বাকও যেন হারিয়ে যায় তার। এক সময় দেশে জয় বাংলা বা আওয়ামী লীগ বলা ছিল কঠিন। দুর্দমনীয় শোকাহত মন্নানরা সে সংকটময় সময়ে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকা যোগে, কখনোবা রিক্সা-বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে এগিয়ে যেতেন। নেমে পড়েন আওয়ামী লীগের শুদ্ধ রাজনীতি চর্চায়। বিশ্ববিবেককে নাড়া দিতে প্রাণান্তর চেষ্টা করেন। পুনসংগঠিত করে তোলেন আওয়ামী লীগ। তিনি কামনা না করলেও স্বতস্ফুর্তভাবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক দক্ষিণ জেলা ও কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি কখনোও হিংস্র ও অপরাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি খুবই ব্যথিত হন দেশে দেশদ্রোহীদের উপদ্রবে।
১৯২৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দাইশের (তৎকালীন পটিয়ার) বিপ্লবতীর্থ বরমা গ্রামে একেএম আবদুল মন্নান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ মহান নেতা ২০০১ সালের ২৩ মার্চ নাফেরার দেশে পাড়ি জমান। তার পিতার নাম এসএম আবদুল অদুদ ও পিতামহের নাম ছাদেক আলী মুনসী। পিতৃভূমি বরমায় সম্প্রতি তার নামে একটি সড়ক (একেএম আবদুল মন্নান সড়ক) ও একেএম আবদুল মন্নান বাড়ি সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাড়ির সামনে নির্মাণ করা হয়েছে একটি দৃষ্টি নন্দন তার ম্যুরাল। ইতিমধ্যে তার জেষ্ঠ্য কন্যা দৈনিক আজাদীর সহ-সম্পাদক ইয়াসমিন ইউসুফের সম্পাদনায় ‘সময়ের পরিক্ষিত জননেতা একেএম আবদুল মন্নান’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যা অনুসন্ধানী পাঠক, দক্ষ ও কৃতী নেতাদের কাছে সাড়া জাগিয়েছে। তার জন্মভূমি বরমা অত্যান্ত উর্বর ও ইতিহাস বিখ্যাত। বরমাকে আদর্শ গ্রাম গড়ার স্বপ্ন বুনতেন ও বরমাকে নিয়ে তিনি গর্ব করতেন।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে তার প্রথম জানাযায় ডজন খানেক মন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয়, নগর, জেলার অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও গনমানুষের ঢল নামে। বরমায় শেষ জানাযা নামাজের পর তাকে রা রাষ্ট্র্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। এটাই ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রথম রা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন। কর্মময় বর্ণময় জীবনে তিনি বহু সেবা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক আদর্শ গৃহিনীর স্বামী এবং এক পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা। সাধারণভাবে তিনি ছেলে-মেয়েদের ভাল ও যোগ্য হিসেবে গড়তে সক্ষম হয়েছেন। নিবেদিত ও নির্মোহ বলে বঙ্গবন্ধুর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি সংঘাতের পরিবর্তে সহনশীলতা চর্চা করতেন। তিনি চেষ্টা করলে সম্পদের পাহাড় গড়তে পারতেন। তা না করে তিনি সোনার দেশ গড়তে চেয়েছেন।
কর্মবীর কিংবদন্তী রাজনীতিক একেএম আবদুল মন্নান। শুদ্ধ রাজনীতির সাধক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর, সমাজ সংস্কারক, কর্মবীর কিংবদন্তী রাজনীতিক একেএম আবদুল মন্নান। যার জীবন ও স্বপ্ন জুড়ে ছিল রক্তার্জিত সবুজ শ্যমলিম বাংলাদেশ, সর্বোপরি মা, মাটি, মানুষ ।
লেখক: সাংবাদিক ও ছড়াকার, বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম