শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

গণতন্ত্রের সিংহপুরুষ কেএম ওবায়দুর রহমান

বুধবার, মার্চ ২২, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

শাহজাহান মিয়া সম্রাট: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, পার্লামেন্ট্রিয়াল গণতন্ত্রের সিংহপুরুষ প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমান ১৯৪০ সালের ৫ মে গোপালগঞ্জ শহরে জন্ম নেন। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত খন্দকার পরিবারের সন্তান কেএম ওবায়দুর রহমান। পিতা খন্দকার আতিকুর রহমান ছিলেন নগরকান্দার এমএন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। মাতা রাবেয়া রহমান আদর্শ গৃহিনী ছিলেন। ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

কেএম ওবায়দুর রহমানের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে নগরকান্দার লস্করদিয়া গ্রামে। দুরন্তপনার কারণে শৈশবে পারিবারিকভাবে যেমনিভাবে চাপের মুখে ছিলেন, তেমনিভাবে স্কুল জীবনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে স্কুল প্রশাসনও তাকে চাপের মুখে রেখেছিলেন।

১৯৪৫ সালে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ ময়দানে শেখ মুজিবর রহমানের জনসভায় যোগ দিতে এসে তিনি হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৫৫ সালে এমএন একাডেমি থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ৫৭ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ বিভাগে বিএ অনার্স ভর্তি হন ও একই বিভাগে তিনি বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৯-৬০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২-৬৩ তে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬-১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র আওয়ামীলীগ প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সর্বকনিষ্ঠ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ও ভারতে আগত বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। এখানে খাদ্য সরবরাহসহ আনুসাঙ্গিক ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে পালন করার জন্য ভারত সরকার ও পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পুরস্কৃত করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি নয় মাস আয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান ও তোফায়েল আহমেদ বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরে রাজনৈতিক কারণে তিনি ১১ বারে মোট সাড়ে ১৩ বছর কারাভোগ করেছেন। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি জেল হত্যা মামলায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন। ৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ৩০ বছর চার মাস বয়সে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগ দেন।

১৯৭৮-১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি জিয়াউর রহমান ও আব্দুর সাত্তারের আমলে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে কারাগার থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাজেদা চৌধুরীকে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালের ২১ মার্চ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৯৫২ সালে প্রথম কেএম ওবায়দুর রহমান গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। এছাড়া, ৫০ এর দশকে আরো দুই মেয়াদে দেড় বছর, ৬০ এর দশকে চার মেয়াদে সাড়ে পাঁচ বছর, ৭০ এর দশকে আট মাস, ৮০ এর দশকে এরশাদের শাসনামলে তিন দফায় এক বছর আট মাস, ৯০ এর দশকে শেখ হাসিনা শাসনামলে জেল হত্যা মামলায় তিন বছর ছয় মাস করাভোগ করেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে কারাভোগ করে তিনি নির্যাতনের শিকার হন এবং হার্ট, ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। ২০০১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর জেল থেকে মুক্তি পান ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ব্যংককে বামরাংগ্রাথ হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারী করেন। ২০০৬ সালে তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে ভারতের স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন ও দেশের এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২০০৭ সালের ২১ মার্চ তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোক গমন করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন।

একজন উদার গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও মেধায় পরিপূর্ণ ছিলেন এ নেতা। তার এসব গুণের কারণে ২০০৭ সালের ৫ মে প্রথম স্মরণ সভায় তাকে ‘গণতন্ত্রের সিংহ পুরুষ’ মরণোত্তর খেতাবে ভূষিত করা হয়।

কেএম ওবায়দুর রহমানের ১৬তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করেছে গণতন্ত্রের সিংহপুরুষ কেএম ওবায়দুর রহমান স্মৃতি সংসদ। কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়ায় কেএম ওবায়দুর রহমানের মাজার জিয়ারত ও বিকালে লস্করদিয়া শ্যামা ডেইরী ফার্ম মাঠে আলোচনা সভা হয়েছে। বুধবার (২২ মার্চ) সকালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কেএম ওবায়দুর রহমানের কর্মময় জীবনীর উপরে আলোচনা সভা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, গণতন্ত্রের সিংহপুরুষ কেএম ওবায়দুর রহমান স্মৃতি সংসদ