সিবিএন ডেস্ক: সদ্যই তৃতীয় মেয়াদে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছেন শি জিনপিং। তাই কী ছিলেন খোশ মেজাজে? ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে হয়তো একারণেই উষ্ণ সুরে কথা বলেছেন। বিশেষ করে, প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তার সংলাপ ছিল খুবই ইতিবাচক। তাইওয়ান, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যসহ দুই দেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনা উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কাই ছিল। কিন্তু, তা না হওয়াতেই বিস্মিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক পর্যবেক্ষক। বিশ্লেষণ দ্য গার্ডিয়ানের
কিন্তু, তাই বলে এমনটাও ভাবার কারণ নেই– যে শি জিনপিংয়ের হৃদ্যতা চীনের আগ্রাসী ‘উলফ ওয়ারিয়র’ খ্যাত কূটনীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বরং সে প্রত্যাশা না রাখাই ভালো।
জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের আগে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছেন শি ও বাইডেন। বৈঠকে তাইওয়ানসহ অন্যান্য ইস্যুতে তাদের মধ্যকার আলোচনাকে ‘প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট’ বলে বর্ণনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনিও নমনীয় ছিলেন শি জিনপিংয়ের সাথে তার প্রথম সরাসরি সংলাপে। তাইওয়ানকে রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে– যুক্তরাষ্ট্র তার ‘এক চীন নীতি’ থেকে চ্যুত হচ্ছে, চীনের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৈঠককালে বাইডেন আশ্বস্ত করে বলেন- ‘নয়া স্নায়ুযুদ্ধ’ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র এই নীতিতে অটল রয়েছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়াস চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্টিভ জ্যাং মনে করেন, ‘বাইডেনের সাথে বৈঠকে তিনি (শি জিনপিং) যা চেয়েছিলেন- তা পেয়েও গেছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতার সীমিত পদক্ষেপ (সংঘাত হলে) তার দায় কমাবে’।
অর্থাৎ, বেইজিং দাবি করতে পারবে, তারা আপোষ মীমাংসার পক্ষে থাকলেও– শান্তির অঙ্গীকার দিয়ে তা ভঙ্গ করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরই দায় বেশি।
এবার শি জিনপিংয়ের বক্তব্যে আসা যাক। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐক্য ও সহযোগিতার বন্ধন গড়ার বিষয়ে বলেছেন। বিশ্ব নেতাদের জড়ো হওয়ার নানান সম্মেলনে এ ধরনের শান্তিকামী বক্তব্য এর আগেও তিনি দিয়েছেন। ব্যতিক্রম হয়নি বাইডেনের সাথে বৈঠকে বা মূল জি-২০ সম্মেলনে।
অথচ গত মাসে এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা তিনি বলেন- চীনা সমাজতন্ত্রী দলের ২০তম পার্টি কংগ্রেসে। এসময় তিনি বৈরী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে টিকে থাকতে চীনের ‘লড়াকু মনোভাবের’ প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেন।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ওয়েন-তি সুং বলেন, ‘২০তম কংগ্রেসে ক্ষমতা সুসংহত হওয়ায় এটা ছিল শি’র উৎসব উদযাপন। এছাড়া, তার জানা আছে– বাইডেনের সাথে তিনি আন্তরিকতার সাথে কথা বললে অন্যান্য দেশও চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। এই সুযোগ এনে দেয়, শি জিনপিংয়ের সাথে বাইডেনের বৈঠক– যা তিনি কাজে লাগাতে একটুও দেরি করেননি। এর মাধ্যমে, যেসব দেশের সাথে তিক্ততা বেড়েছে তাদের প্রতি সম্পর্কোন্নয়নের এক ইতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছেন’।
তবে বেইজিংয়ের শিংগুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক উ কিয়াং মনে করেন, দুই নেতার ওই সম্প্রীতিমূলক আচরণ ছিল- প্রতীকী সৌজন্য মাত্র, যার বুনিয়াদ আগে থেকেই দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে গড়া হয়’।
তিনি বলেন, ‘আরেকটি বড় কারণ- নতুন মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি ছিল বিশ্বমঞ্চে তার ফিরে আসার রাজনৈতিক শো। তিনি তার ক্ষমতার প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের চেষ্টাও করেছেন’।
উ বলেন, সম্মেলনে শি জিনপিংয়ের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে ভাঙনের মুখে থাকা সম্পর্ক মেরামত। আর ছিল- উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ও মিসাইল কর্মসূচি ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তেজনা প্রশমন এবং বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপের মন জয়।
তবে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সহমত ব্যক্ত হওয়ার চেয়ে– বিশ্বনেতাদের সাথে শি জিনপিংয়ের বৈঠকগুলিতে চীনের অবস্থানের একতরফা ঘোষণাই বেশি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
উ বলেন, প্রকৃত অগ্রগতি ছিল খুবই সীমিত। পুরো বিষয়টিকে অনেকটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের চেষ্টা বলা যায়। সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের চেষ্টাকে তাই প্রতীকী বলছি, এবং তা শুধু প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারের জন্যই নয়। তাই জি-২০ সম্মেলনে শি সফল হয়েছেন একথাও বলা যায় না’।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো উইলি ল্যাম মনে করেন, শির প্রধান লক্ষ্যই ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্রদের মধ্যে ‘ফাটল সৃষ্টির’। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আসিয়ান জোটভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্কেও তিনি চিড় ধরাতে চেয়েছেন।
যেমন জি-২০ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ‘জোট রাজনীতির’ প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন শি জিনপিং। একইসাথে, ‘শিল্প ও কাঁচামাল সরবরাহ চক্র নিষ্কন্টক’ রাখার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিরও পরোক্ষ সমালোচনা করেছেন।
(মার্কিন প্রভাব থেকে) ‘স্বাধীন ও চীনের বিষয়ে ইতিবাচক নীতি ধরে রাখতে’ ইইউকে উৎসাহ দিতেও ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ল্যামের মতে, এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ইউরোপ যেন চীনের কাছে উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি বিক্রি বন্ধ করার পদক্ষেপ না নেয়– তারই আহ্বান।
ল্যাম জানান, জি-২০ সম্মেলনে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির বিরোধিতা করে শি দেশগুলির নেতাদের প্রশংসা পেয়েছেন। একইসাথে বিশ্ব নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, চীনের মুক্তদ্বার নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে এই প্রচেষ্টায় শি কতোটা সফল হবেন ‘সেকথা এখনই বলার সময় আসেনি’ বলেও মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ। কারণ চীনের অর্থনীতি ও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে উচ্চপ্রযুক্তি পাওয়ার বিষয়ে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার: আগামী পাঁচ বা ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের পরাশক্তি হতে চলা একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শি জিনপিং বিশ্বনেতাদের অনুমোদন লাভ করেছেন। এবং তারা যে অন্যান্য ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে চীনের সাথে বাণিজ্য চলমান রাখতেও আগ্রহী সেই বার্তাও দিয়েছেন।