ডেস্ক প্রতিবেদন: একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাবের সাথে আরম্ভ হওয়া ডেঙ্গু মহামারি এখন একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ। এই মহাসংকটের মধ্যে ফের সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু ও এর চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা। সরাসরি চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে অনেকেই নির্ভর করা শুরু করেছেন এই প্রচলিত ধারণাগুলোর ওপর। এই বিপথগামীতার সাপেক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে দ্রুত গণসচেতনা সৃষ্টি। এই সচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে জানুন, ডেঙ্গু নিয়ে দশ প্রচলিত ধারণা।
ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ: এই ভুল ধারণার কারণে অধিকাংশ মানুষই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু, ডেঙ্গু সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে অন্য কোন ব্যক্তি এলে তিনি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন না। ডেঙ্গু রোগ মূলত ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারি এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে, সংক্রামিত গর্ভবতী মায়ের থেকে ভ্রূণে চলে যেতে পারে এই ভাইরাস। এছাড়া, রক্ত ও অঙ্গদানের মাধ্যমেও এই স্থানান্তরটা হতে পারে। তবে, এমন সংক্রমণের দৃষ্টান্ত বিরল।
ডেঙ্গু শুধু গ্রাম এলাকা বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হয়: গ্রামাঞ্চলে খেত-খামার, বন-জঙ্গলের আধিক্যের কারণে অনেকেই এমনটা ভেবে থাকেন। এছাড়া, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অধিক দেখা যায়। তাই বলে, উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম ডেঙ্গু ঝুঁকিপূর্ণ হবে, বিষয়টি তা নয়। উন্নত দেশগুলোতে দ্রুত চিকিৎসা নেয়ার সুবিধা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপটা কম বলা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে শহর-গ্রাম উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ; যে স্থানই হোক না কেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস মশা রয়েছে এমন যে কোন স্থানই ঝুঁকিপূর্ণ।
শুধুমাত্র শিশু ও বয়স্কদের ডেঙ্গু হয়: শিশু আর বৃদ্ধরাই শুধু ডেঙ্গুর শিকার হয়- তা যে একেবারেই অমূলক, তা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। আসলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বয়স কোন কারণ নয়। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অনেক বয়স্ক লোকদের মধ্যেও বেশ ভাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখা যায়। অন্য দিকে, এই ক্ষমতার দিক দিয়ে দুর্বল হওয়ার কারণে যৌবনে পদার্পণকারি সুঠাম দেহের মানুষও ডেঙ্গুর শিকার হতে পারেন।
যে কোন মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়: এটি একেবারেই ভুল ধারণা। ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের প্রজাতির স্ত্রী মশা। এই এডিস ইজিপ্টি প্রজাতিটি অনেক বড়। এদের পা বা উপাঙ্গুলোতে সাদা দাগ থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তিকে এই মশা কামড়ালে, এটি সেই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ অবস্থায় প্রায় এক সপ্তাহ বা তার পরে মশাটি কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তার ডেঙ্গু রোগ হবে।
ডেঙ্গু মশা শুধু দিনেই কামড় দেয়: ডেঙ্গু ছড়ানো মশা দিনের বেলায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। বেশিরভাগ সময় সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা পরে ও সূর্যাস্তের কয়েক ঘণ্টা আগে। কিন্তু, তাই বলে যে এগুলো রাতে কামড়ায় না- এমনটি নয়। রাতের বেলা সাধারণত অফিস, মল ও ইনডোর অডিটোরিয়ামের মধ্যে অধিক আলোকিত জায়গায় এই মশার উৎপাত বেশি থাকে।
ডেঙ্গু জীবনে কেবল এক বারই হয়: অনেকেই ভেবে থাকেন যে, যার এক বার ডেঙ্গু হয়েছে, তার আর কখনো ডেঙ্গু হবে না। এটি একদমই সঠিক নয়। ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়ে থাকে। এগুলোকে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ নামে চিহ্নিত করা হয়। এখানে ডেন-১ কামড়ানোর পর সংক্রমিত ব্যক্তি সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে গেলে তিনি ডেন-১ থেকে অনাক্রম্যতা পাবেন। কিন্তু, পরবর্তী ডেন-২-এর কামড় খাওয়ার পর তিনি ফের সংক্রমিত হয়ে যাবেন। অর্থাৎ, সুস্থ হওয়ার পর এক ধরনের মশা থেকে রক্ষা পেলেও অন্যান্য ধরণগুলোর জন্য ঝুঁকি থেকে যাবে। তাত্ত্বিকভাবে বিবেচনা করলে, এভাবে জীবনে চার বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ছাগলের দুধ, গিলয় ও পেঁপে পাতার রস খেলে ডেঙ্গু নিরাময় হয়: ছাগলে দুধ, গিলয় ও পেঁপে পাতার রসের বিপুল স্বাস্থ্যগুণ থাকায় অনেকেই এমন দাবি করেন। কিন্তু, ডেঙ্গুর নিরাময়ে এদের সরাসরি কোন ভূমিকা নেই। পেঁপের রস প্লাটিলেট উৎপাদনে সাহায্য করতে পারে। তবে, তা অনেক অল্প পরিমাণে ও এটি কোন তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা অনুসারে, ওষুধের পাশাপাশি সম্পূরক হিসেবে ছাগলের দুধ, পেঁপে বা গিলয়ের নির্যাস খাওয়া যেতে পেতে পারে। তবে, ডেঙ্গু নিরাময়ের জন্য পুরোপুরি এগুলোর উপর নির্ভর করা যাবে না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এগুলো উল্টো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পেঁপে ও গিলয়ের রস খেলে গ্যাস্ট্রিক ও বমি হতে পারে। ডেঙ্গুর সময় এই বমি বা বমি ভাব এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা প্লাটিলেটের হ্রাস-বৃদ্ধি তদারক করে থাকেন। এ সময় শরীরের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত চাপ-সৃষ্টি হয়- এমন ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
শরীরে কম প্লাটিলেট মানেই তার ডেঙ্গু হয়েছে: এই প্রচলিত ধারণাটি বর্তমানে রীতিমত একটি প্রতিষ্ঠিত বিঃশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কম প্লাটিলেটের সাথে আরো কিছু উপসর্গ আছে, যেগুলো দেখা দিলে সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু, শুধুমাত্র প্লাটিলেট কমে যাওয়া মানেই ডেঙ্গু রোগ নয়। এছাড়া, সব ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যাবে, সব সময় এমনটিও হয় না। আবার কম প্লাটিলেট সংখ্যার রোগীদের সব সময় ডেঙ্গু ধরা পড়ে না। এটি অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের ফলও হতে পারে। ক্যান্সার রোগী ও যাদের রক্তস্বল্পতা রয়েছে, তাদের নিয়মিত নির্দিষ্ট ধরনের পথ্য গ্রহণের কারণে তাদের প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে।
ডেঙ্গু হওয়ার সাথে সাথেই প্লাটিলেট নিতে হয়: ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার সাথে সাথেই বা যখনি ডেঙ্গু জ্বর হবে, তখনি প্লাটিলেট নিতে হবে- এটা ভুল। সাধারণত, একটি সুস্থ মানুষের দেহে প্লাটিলেটের সংখ্যা থাকে দেড় লাখ থেকে চার লাখ দশ হাজার। কিন্তু, ডেঙ্গু জ্বরের চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে এই সংখ্যা দেড় লাখ থেকে ৫০ হাজারে নেমে যেতে পারে। প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন বা স্থানান্তর তখনই করা হয়, যখন প্লাটিলেট লেভেল দশ হাজারের নিচে নেমে যায় বা কোন রক্তপাত ঘটে।
প্লাটিলেট বাড়ানোর একমাত্র উপায় প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন: ডেঙ্গু জ্বরের জরুরি অবস্থায় প্লাটিলেট বৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শুধুমাত্র প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশনের উপর নির্ভর করে অনেকে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই প্রচলিত ধারণার কারণে অনেকেই ভুলে যান প্লাটিলেট বৃদ্ধির অন্যান্য উপায়গুলোর কথা। কৃত্রিম উপায় ছাড়াও প্লাটিলেট স্বাভাবিকভাবে বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশনের পাশাপাশি অন্যান্য ওষুধ দেন। সেই সাথে গড়ে তুলতে বলেন প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাস। এই খাদ্যাভাসে আছে- পেঁপে পাতার নির্যাস, যেখানে থাকা এএলওএক্স-১২ এনজাইম প্রাকৃতিকভাবে প্লাটিলেট গঠনকে উদ্দীপিত করে। ডাবের পানি ও ডালিমের রস, যেগুলো শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে দূরে রাখে। ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন- কমলা, ক্র্যানবেরি, টমেটো ও ড্রাগন ফল।
পরিশেষে বলা যায়, ডেঙ্গুর প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট কোন প্রতিকার নেই। কিন্তু, আছে প্রতিরোধের উপায়। হালকা উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে সঠিক চিকিৎসা নিলে গুরুতর জটিলতা থেকে মুক্তি মিলতে পারে। এই প্রতিরোধকল্পে ডেঙ্গু সম্পর্কে উপরোক্ত দশ ভুল ধারণা দূর করা আবশ্যক। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হচ্ছে, এখনো অনেকেই মনে করেন যে, ডেঙ্গু ততটা গুরুতর নয়। কিন্তু, সকলের জানা থাকা উচিত যে, ডেঙ্গু রোগের সময়কালীন ব্যথা সহ্য করা কঠিন। সঠিক চিকিৎসা নিতে যত দেরি হবে, এটি তত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই, প্রচলিত ধারণার ওপর নির্ভর না করে সরাসরি চিকিৎসকের সরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। বিশেষত, প্রাথমিক অবস্থাতেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাস গড়ে তুললে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে।