শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

দোদুল্যমান রাজ্যগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করবে

রবিবার, অক্টোবর ১৩, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ফরিদুল আলম: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে আর এক মাসের কম সময়। এ সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি মুহূর্তে নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। তবে, এখানে উল্লেখ করার মত একটি ব্যাপারে হচ্ছে, যে মুহূর্তে কমলা হ্যারিস প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে লড়তে যাচ্ছেন বলে নির্ধারিত হয়েছে, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি একটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং এখন পর্যন্ত মোটামুটি সব জনমত জরিপে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে কয়েক পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন।

ট্রাম্প-কমলার মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সর্বশেষ পরিচালিত সিয়েনা কলেজ ও নিউইয়র্ক টাইমসের জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের চেয়ে তিন পয়েন্ট এগিয়ে ৪৯ পয়েন্ট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন কমলা। তবে, অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনায় বলা যায়, নির্বাচনের পূর্বে পরিচালিত এসব জনমত জরিপ সব সময় সত্য হয় না, যা নিকট অতীতে দেখা গেছে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, রাজ্যওয়ারি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট। ধরা যাক, কোন রাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট রয়েছে ২৫টি, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যে ব্যবধানেই জয়লাভ করুন না কেন, সব কয়টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট তিনি পেয়ে যাবেন।

সে হিসেবে একটি দেশের মোট জনগণের একটি অংশের ওপর পরিচালিত জনমত জরিপের ফল দিয়ে প্রতিটি রাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের হিসাব মেলানো কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবকের কাজ করে দুইটি ব্যাপার- প্রথমত, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক এবং দ্বিতীয়ত, দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো। এবারের নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে একটিমাত্র টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ট্রাম্পের তুলনায় কমলা ভাল করেছেন বলে জনমত জরিপে উঠে এসেছে। আরো বিতর্কের ব্যাপারে কমলার পক্ষ থেকে আগ্রহ থাকলেও ট্রাম্পের অনীহার কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি।

অবশ্য দুই প্রার্থীর রানিং মেটদের মধ্যে একটিমাত্র বিতর্কে দুইজনই সমান তালে একে অপরকে মোকাবেলা করেছেন। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর মধ্যে এবার এ রকম সাতটি অঙ্গরাজ্য রয়েছে, যেখানে ভোটাররা কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে চান। এ ক্ষেত্রে যারা নিবন্ধিত ভোটার, তাদের বেশির ভাগ এগিয়ে রাখছে কমলাকে, আবার অভিজ্ঞতার বিবেচনায় অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দিতে চাইছেন।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে আগ্রহ পুরো বিশ্বেই। তবে, বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র বা ‘হেজিমনিক রাষ্ট্র’ বিবেচনায় ভোটাররা যে ভোটের ক্ষেত্রে এসব খুব বিবেচনায় নেন, সেটা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই।

বহু ক্ষেত্রে বরং এটা বলা চলে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যকে ধরে রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক নীতি রয়েছে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটার খুব একটা প্রতিফলন ঘটে না। বহুলাংশে তারা বরং অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেই সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেন এবং এসব ক্ষেত্রে রাজ্যের গভর্নর নির্বাচনকে তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে গভর্নররা যেহেতু রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেটিক কোন না কোন দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সে ক্ষেত্রে তাদের জনপ্রিয়তা থাকা না থাকার ওপর নির্দিষ্ট অঙ্গরাজ্যগুলোতে ভোটের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসরায়েল লবি বা ইহুদি লবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে বহু অঙ্গরাজ্যের গভর্নর বা কংগ্রেসম্যান নির্বাচনে ইহুদি লবির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা দেশটির গোটা রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে।

ইসরায়েলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ ঘটানোর সে অর্থে কোন সুযোগ নেই। তাই, আমরা বরাবরই দেখি, যখন যিনিই নির্বাচিত হন, তাকে ইসরায়েলের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতে হয়। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের গাজা ও লেবাননে ইসরায়েল কর্তৃক আগ্রাসী তৎপরতায় ব্যাপক সংখ্যায় বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা এবং এর জের ধরে বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ বিরাজ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ইসরায়েলের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নীতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। এর মাধ্যমে ট্রাম্পের ইসরায়েলপ্রীতির প্রকাশ ঘটলেও এ ক্ষেত্রে অনেকটাই কৌশলী ছিলেন কমলা হ্যারিস। একই সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব কমনসে ভাষণ দেন, যেখানে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল ভাইস প্রেসিডেন্টের। কৌশলে নিজের নির্বাচনী ব্যস্ততার কথা বলে সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন কমলা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে এলেও এটি কমলার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটায় না। কমলা বরং শুরু থেকেই ইসরায়েলের পক্ষ বা বিপক্ষ কোন অবস্থান না নিয়ে গাজায় বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে বাইডেন ও ট্রাম্পের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের দিকটি যতটা সরাসরি, এ জায়গায় কমলার অবস্থান অনেকটা নিরপেক্ষ।

এবারের নির্বাচনে সাতটি অঙ্গরাজ্যকে দোদুল্যমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম উইসকনসিন, যেখানে কমলা হ্যারিস সমর্থন পেয়েছেন প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান নেতা ডিক চেনি ও তার মেয়ে এবং প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান লিজ চেনির। এ ব্যাটল গ্রাউন্ডগুলোতে আরব মুসলিম, গাজা ইস্যু ও তরুণ ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্যের বাদবাকিগুলোতে ইলেকটোরাল কলেজের হিসাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থা প্রায় সমানে সমান। এ ক্ষেত্রে উভয় প্রার্থীর মনোযোগ রয়েছে দোদুল্যমান এ অঙ্গরাজ্যগুলোতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করায়। আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকার কথা যে, ২০০০ সালের নির্বাচনে এ রকম একটি ব্যাটল গ্রাউন্ড ছিল ফ্লোরিডা, যার ফলাফলে মাত্র একটি ইলেকটোরাল কলেজের ব্যবধানে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আল গোরকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান জর্জ ডব্লিউ বুশ। যে বিষয়গুলো নিয়ে ভোটাররা দোদুল্যমান থাকেন, এরই মধ্যে এ দিক দিয়ে কমলা অনেকটাই তাদের মন জয় করতে পারলেও মূলধারার আমেরিকানদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়ে আগ্রহ বেশি। কমলা একজন আফ্রো-এশিয়ান আমেরিকান, সে অর্থে মূলধারার নন। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলতে তিনি জো বাইডেনের ডেপুটি হিসেবে চার বছর কাজ করলেও এ ক্ষেত্রে তাকে সব সময় প্রেসিডেন্টের অনুসৃত নীতিকেই সমর্থন করতে হয়েছে। সেদিক দিয়ে ট্রাম্পের রয়েছে পুরো এক মেয়াদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা, যদিও এটি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

সময় যতই গড়াচ্ছে, নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে অস্পষ্টতা ততই বাড়ছে। এ কথা ঠিক যে, যখন এটি নির্দিষ্ট হয়েছিল যে ট্রাম্পের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন জো বাইডেন, তখন সুস্পষ্টভাবেই বাইডেনের তুলনায় তিনি এগিয়ে ছিলেন। ঘটনা আচানক পাল্টে যায়, যখন বাইডেন নিজ থেকে সরে গিয়ে কমলার নাম প্রস্তাব করেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের একগুঁয়েমি আচরণের বিপক্ষে ও বাইডেনের মত বয়সের ভারে ন্যুব্জ একজন প্রার্থীর বদলে ডেমোক্র্যাট শিবির এমন একজন প্রার্থী পায়, যাকে নিয়ে সরব হয়ে ওঠে নির্বাচনের মাঠ। উঠে আসতে থাকে ট্রাম্পের এক মেয়াদের যত ব্যর্থতা ও কমলার প্রতি সহমর্মিতা। এসব কিছুই এখন পর্যন্ত যে কমলাকে জয়ী করতে সন্দেহাতীতভাবে কাজ করবে, সেটিও নিশ্চিত করে বলার অবকাশ নেই। কারণ, একটিই, দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটের হিসাব-নিকাশ এবং একটি বড় অংশের ভোটার, যারা এখনো মনস্থির করেননি, তারা কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন।

চার বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ট্রাম্প নিজ দেশের বাইরেও তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কে চিড় ধরানো ছাড়াও তিনি ন্যাটোকে অকার্যকর বলে মন্তব্য করে সমালোচিত ছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্যারিস চুক্তি, ট্রান্সপ্যাসিফিক চুক্তি ও ইরানের সাথে ছয় জাতির চুক্তি থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ফলাফল না মেনে ও ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় নিজ দেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হন। সম্প্রতি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এর বিপরীতে কমলা হ্যারিস অনেকটাই ক্লিন ইমেজের একজন প্রার্থী, যার প্রতি রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলমান, তরুণ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন। তার পরও দিনশেষে এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ব্যক্তিটি নির্বাচিত হচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে বলতে হয়, সাতটি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পাঁচটিতেই এখন পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গেল মাসের মাঝামাঝি পরিচালিত জরিপে এমনটিই ধারণা পাওয়া গেছে। কিছু দিন পূর্বেও এর বেশির ভাগ রাজ্যেই এগিয়ে ছিলেন কমলা। তবে, নির্বাচনের এখনো আরো কয়েক সপ্তাহ বাকি রয়েছে এবং দুই প্রার্থীরই বিভিন্ন কৌশলে ভোটারদের আরো কাছে টানার সুযোগ রয়েছে। এক সময় ট্রাম্পের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে বাইডেনের বয়সকে যেমন বড় বাধা হিসেবে রিপাবলিকান শিবির থেকে প্রচার করা হতো, এর সুযোগ এখন পাচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা। নির্বাচনে শারীরিক-মানসিক সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা প্রভূতি যদি যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচ্য হয়ে থাকে, তাহলে ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প, নাকি ৫৯ বছর বয়সী কমলা- কে বেশি যোগ্য, সেটিই এখন দেখার ব্যাপার।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়