ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ‘চূড়ান্ত রায়’ দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আরো কঠিন হয়ে পড়তে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগ যদি একাই নির্বাচন করে, যদি ৯৮ শতাংশ ভোটও পায়, আপনারা বলতে পারবেন না যে, সেই ভোটগুলো বিএনপির কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাই, এই বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত।’
সম্প্রতি ইউএনবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং দিন শেষে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথেও একটি ভাল সম্পর্ক রাখতে চায়।’
এ দিকে, বাংলাদেশ সরকার বার বার বলে আসছে, তারা দেশে একটি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামী বছরের জানুয়ারিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরেকটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি তুলে ধরে কুগেলম্যান বলেন, ‘যদি নির্বাচন হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র মনে করে অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়ে কারচুপির নির্বাচন হয়েছে, তাহলে এরপর মার্কিন সরকার বাংলাদেশের সাথে তার ভবিষ্যত সম্পর্ক পর্যালোচনা শুরু করলে তিনি অবাক হবেন না।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘আমি মনে করি, বাইডেন প্রশাসন ঢাকার উপর এত চাপ সৃষ্টি, ভিসা নীতি ঘোষণা, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তার একটি কারণ হল তারা ক্ষমতাসীন দলকে চাপ দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার; তা করাতে চায়। যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে এই সম্পর্কের ভবিষ্যত কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে না হয়।’
প্রথম বার ঢাকা সফরে আসা কুগেলম্যান বলেছেন, ‘মার্কিন প্রশাসন ঢাকাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা সম্পৃক্ততা কমানোর মত কোন বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে চায় না।’
‘আমরা সম্পর্ক হ্রাস বা কমানোর ব্যাপারটি উড়িয়ে দিতে পারি না। আমি আশা করি, এ রকম কিছু হবে না। তবে, আমি মনে করি, এ রকম একটা আশঙ্কা আছে।’
তিনি জানান, যদিও সত্যিই কি ঘটছে, সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই; তবে নির্বাচনী ফলাফল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ার একটি খুব ভাল সম্ভাবনা আছে।
নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বৈদেশিক নীতি বিষয়ক সাপ্তাহিকি ‘দক্ষিণ এশিয়া ব্রিফ’ এর লেখক কুগেলম্যান বলেন, ‘এটি সত্যিই খুব অমীমাংসিত ও একটি অনিশ্চিত সময়। কারণ, নির্বাচনের ফলাফল, বিরোধী দল অংশগ্রহণ করবে নাকি বয়কট করবে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আর কি ঘটতে পারে- প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একজন বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি এখানে যে পরিস্থিতি দেখছি, সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে একই পরিস্থিতি বিদ্যমান।’
কুগেলম্যান বলেন, তার মতে ‘এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করবে কিনা? কারণ, তারা এতে অংশ না নিলে নির্বাচনের পুরো প্রেক্ষাপটই বদলে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য ও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।’
তিনি মনে করেন, নির্বাচনের ফলাফল ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে সমর্থন করছে-জনগণের এমন ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনমতকে অতি সাধারণীকরণ করতে চাই না। তবে আমি বলব, বাইডেন প্রশাসন বিএনপির প্রতি পক্ষপাত করছে না।’
তার মতে, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতির জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র বানানোর চেষ্টা করছে।’
কুগেলম্যান বলেছেন, ‘অন্যভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশে তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রচারের নীতি প্রয়োগ করছে। এটি একটি বিশেষ নীতি, যা পাকিস্তান ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশে দৃশ্যমান নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, কে ক্ষমতায় আছে এবং কে বিরোধী দলে আছে, তার চেয়ে বেশি এটি নীতিগত এবং অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়।’
কঠিন অবস্থান: এক প্রশ্নের জবাবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন কঠিন অবস্থানে রয়েছে। ‘আমার যুক্তিতে দেশটি এখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতি দুই ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বলা চলে বাংলাদেশ এখন খুব অস্থির ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক সময়ের মুখোমুখি।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়াও, বাংলাদেশ আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রচণ্ড ভূ-রাজনৈতিক চাপে রয়েছে। দেশটিকে ঘিরে এর প্রতিবেশী একাধিক বড় শক্তির প্রতিযোগিতা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি তাদের এ দ্বন্দ্ব সীমা ছাড়িয়ে, তবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের মত দীর্ঘ মেয়াদী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এবং আমি মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তনকে দীর্ঘ মেয়াদী চ্যালেঞ্জ হিসেবে গুরুত্ব দিতে ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ কুগেলম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে রাজনৈতিক ইস্যু ও ভূ-রাজনৈতিক চাপের সাথে অবশ্যই অর্থনীতিক চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করছে।তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। তবে, কয়েক বছর আগের মত এখন আর ততটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নেই।’ কুগেলম্যান বলেছেন, ‘তবে, জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ হুমকিও কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। তাই, আমি মনে করি, এটি তাৎক্ষণিক সংকট সমাধানে ফোকাস করা ও দীর্ঘ মেয়াদী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্যও নীতিগত অবস্থান নিশ্চিত করার মধ্যে ভারসাম্য রাখার বিষয়।’
ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র করা: চার বৃহৎ শক্তির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি এটিকে সুতীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে অভিহিত করব। বাংলাদেশ মূলত ভারত-চীন; যুক্তরাষ্ট্র-চীন ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া- এই তিনটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই চারটি দেশের সাথেই ঢাকার সম্পর্ক রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি নীতি এবং পছন্দ ও অগ্রাধিকারের উপর জোর দেয়। যা মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি ও চীনের বৈদেশিক নীতির ধারণাগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। আমি এটাকে কৌশলের বদলে আউটলুক নাম দেয়াটা ঢাকার জন্য খুবই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করি। যদি এটি একটি কৌশল হত, তাহলে আরো আনুষ্ঠানিক নথি প্রকাশ করতে হত। কিন্তু, এটি যদি কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গি হয়, তাহলে বিষয়টি আরেকটু বেশি অনানুষ্ঠানিক বলে মনে হয়।’ তিনি মনে করেন, এটির উদ্দেশ্য চীন ও রাশিয়া উভয়ের কাছে একটি সংকেত পাঠানো যে, বাংলাদেশ মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে সমর্থন করার জন্য এই ইন্দো-প্যাসিফিক নথিটি তৈরি করেনি।
ব্রিকস সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশ: কুগেলম্যান মনে করেন, এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক যে, তারা সামর্থ্য অনুযায়ী বিশ্বমঞ্চে গুরুত্ব পাওয়ার মত একজন খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ব্রিকস একটি সমস্যাগ্রস্ত সংগঠন ও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এটি সংগ্রাম করছে। এবং আমি মনে করি, ইরান এখন ব্রিকস-এ যোগ দেয়ার সাথে সাথে পশ্চিমারা এটিকে পশ্চিম-বিরোধী ব্লক হিসেবে মনে করতে শুরু করবে। যদিও, আমি মনে করি এটি একটি ভুল ধারণা।’ তিনি বলেন, ‘অনেকের মতে, এবার সদস্যপদ না পাওয়া বাংলাদেশের জন্য খুব খারাপ কিছু হয়নি। ‘আমি মনে করি ভবিষ্যতে সংগঠনটির সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তখন বাংলাদেশ এতে যোগ দিতে পারবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিকসে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের মত শক্তিশালী প্রার্থীর সংখ্যা কম। এটি একটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতি। এটি একটি এশিয়ান দেশও। এবারের ছয়টি নতুন সদস্য দেখে আমি হতবাক হয়েছি, তাদের কেউই এশিয়ার নয়।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ব্রিকস-এ চীন, ভারতসহ কেউই বাংলাদেশের বিরোধী নয়। তাই, আমি মনে করি বাংলাদেশ যদি এতে যোগ দিতে চায় তবে সে যথেষ্ট সুযোগ পাবে।’
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ মজবুত রয়েছে। কিন্তু, দীর্ঘ মেয়াদের কথা বললে, আমি মনে করি, আপনারদের চিন্তা করতে হবে। এটি এমন একটি অর্থনীতি; যা এত দিন ধরে পোশাক রপ্তানি ও টেক্সটাইলগুলোতে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু, এখন অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে।’
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এমন একটি সময় আসবে, যখন বাংলাদেশকে তার শীর্ষ রপ্তানির উৎসগুলোকে আরো বৈচিত্র্যময় করার কথা ভাবতে হবে। যাতে, প্রকৃত বড় অর্থনীতির সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য দেশটি আরো ভাল অবস্থানে থাকে।’