সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

নির্বাচন: যেভাবে আওয়ামী লীগ বিদেশি চাপ সামলাচ্ছে

মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ এ বক্তব্যে এখনো অনড়। আর বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। এমন বক্তব্যে বিএনপিও অনড়। ফলে, দিন দিন পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এর মধ্যে বিদেশি কূটনীতিবিদদের তৎপরতাও বাড়ছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরই মধ্যে কূটনীতিকদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। কিন্তু, বরফ গলার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। খবর ডয়চে ভেলের।

আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিনিধি দলের সদস্য সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যেসব কূটনীতিবিদদের সাথে বৈঠক করেছি, তাদের কেউই আমাদের বলেনি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দিতে হবে। তারা আমাদের বলেছেন, একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা। বর্তমান সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আন্তরিক। সেটা আমরা বিদেশিদেরও বলেছি। বর্তমান সংবিধানের আলোকে যতোটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব, তার ব্যবস্থা করবে নির্বাচন কমিশন। আমাদের নির্বাচন কমিশন এখন স্বাধীন। আমরা যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিচ্ছি, এখন ভারত সেই প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। কিছু দিন আগে তাদের উচ্চ আদালত বলেছে, ‘একটা কমিটি গঠন করে সেই কমিটির কাছ থেকে নাম নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে।’ আমরা গত দুই বার এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন করেছি। এখন কেউ কী বলতে পারবেন, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারেরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য? একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা করা প্রয়োজন, তারা সেটা করবেন।’

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যের বিদায়ী হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যের পর্যবেকদের স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ।’ ওই বৈঠকেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘একটি দেশের সংবিধান নিয়ে বিদেশি কোন কূটনীতিক কথা বলতে পারেন না। ফলে, কূটনীতিবিদদের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা সম্ভব না। আর এ সুবিধাটাই পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা বার বার সংবিধানের কথাই বলছেন।’

কত জন পর্যবেক্ষক এলে তা কোনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কোন দেশ থেকে কত পর্যবেক্ষক এল, এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। বিদেশিরাও আমাদের কোন সমাধান দিতে পারবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। একটা দেশের সংবিধান নিয়ে কী কোন কূটনীতিবিদ কোন কথা বলবেন? এটা তো শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে না। সরকার যদি চায়, একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। তাহলে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে সমাধান করতে পারে। যে নির্বাচনটা আমাদের দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সর্বশেষ দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কী আমাদের দেশের মানুষের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে? যদি না হয়, তাহলে কী করলে সেটা গ্রহণযোগ্য করা যাবে, সে ব্যবস্থা চাইলেই সরকার করতে পারে।’

গেল ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সাথে বৈঠক করেন। দেশে ফিরে মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র চায় না। তারা চায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী নির্বাচন চায়। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন পদেক্ষেপে তারা খুশি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, বাংলাদেশে একটি আদর্শ নির্বাচন হোক। তবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন।’

দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বৈঠকের পর গেল ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন বলেন, ‘আমরা সব সময় বলেছি, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন হয়েছে। বাংলাদেশ একটি বায়োমেট্রিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং স্বচ্ছ ব্যালেট বক্স ব্যবস্থা করেছে মূলত স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালনের জন্য অনেক দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যোগাযোগ রাখছে।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিনিধি দলের সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, ‘আমরা বিদেশিদের সাথে যে বৈঠকগুলো করেছি, সেখানে স্পষ্ট করেই বলেছি, বর্তমান সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য কোন নামে হলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে আসছি।’

কিন্তু কূটনীতিবিদেরা তো সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে বৈঠকে নির্দলীয় সরকারের কোন কথাই বলছেন না? তাহলে কী আপনাদের দাবি তারা গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে না? জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, ‘একটা দেশের সংবিধান নিয়ে তো কূটনীতিবিদেরা কথা বলতে পারেন না। এ কারণেই তারা জোর দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। তাদের এ জোর দেয়ার মধ্যেই নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার ইঙ্গিত রয়েছে। সরকারি দলে সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করছে।’

গেল তিন মাস ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সাথে একাধিক দেশের কূটনীতিক বৈঠক করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না, এটা পরিষ্কার। তবে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এ জন্য, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা তারা বলেন। এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাতটি দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেন।

গত ১২ মার্চ বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) আটটি দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেন। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির গুলশানের বাসায় এ বৈঠক হয়। এর মধ্যে গত তিন মানে দুই বার বিএনপি প্রতিনিধি দলের দলের সাথে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। ফলে, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহের বিষয়টি ইতিমধ্যে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রদূত লেফট্যানান্ট জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বিদেশিদের এ তৎপরতা আমাদের রাজনীতিবিদদের দৈন্যতা। আমরা তাদের কাছে যাচ্ছি বলেই তারা মোড়লের মতো পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের ভোট কীভাবে হবে, গ্রহণযোগ্য হল কিনা সেটা নির্ধারণ করবে জনগণ। যুক্তরাষ্ট্রে এবার ভোটের পর ট্রাম্পের লোকজন প্রশ্ন তুলেছেন। তাতে কী হয়েছে? ওই দেশের জনগণ তো মনে করেছে গ্রহণযোগ্য ভোট হয়েছে। আমাদের এখানেও তাই। বিএনপি যে এখন তত্ত্বাবধায়াক সরকারের কথা বলছে, সে সময়েও কী সবাই ভোটের ফল মেনে নিয়েছে? যারা হেরেছে তারা তো নানা প্রশ্ন তুলেছে? ভোটের ফল মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। দেশের মানুষের কাছে কীভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, সে চিন্তাই করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।’