বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

পঁচাত্তরের আগষ্ট বেদনার্ত হৃদয়ে লেখা স্মৃতিকথা

রবিবার, আগস্ট ১৪, ২০২২

প্রিন্ট করুন

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী: আগষ্ট। বাঙালি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত বেদনা বিদুর, অশ্রু ঝরানো, শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতি হারিয়েছে তার অমূল্য রতন। বাংলার জনপদে নিরলস ছুটে চলায় যিনি বাঙালি জাতিসত্বাকে মুক্তির মোহনায় উপনীত করেছিলেন, জীবনের শ্রেষ্ট সময়টুকু বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে কারান্তরীন হয়ে কাটিয়েছিলেন, যার তর্জনী হেলনে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামী ও গেরিলা যোদ্ধা হয়ে ওঠেছিল, এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালির কপালে কালিমা লেপন করে স্বার্থলোভী ও চাকুরিচ্যুত কতিপয় সেনা কর্মকর্তা। তাদের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু দেশী, বিদেশী কুচক্রী মহল। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই আস্তে আস্তে জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপর খন্দকার মোস্তাক স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও মেজয় জিয়া সেনা প্রধানের দায়িত্বে এসে তাদের কলুষযুক্ত চেহারা উম্মোচন করে।

১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান এ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে।
দীর্ঘ ২১ বছর নানা ছল ছাতুরী, হামলা, মামলা ও নির্যাতন করে আওয়ামী লীগকে জাতীয় রাজনীতিতে কোনঠাসা করে, ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনী ও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শত ঝড়, ঝঞ্ঝা বুকে নিয়ে, রোদ, বৃষ্টি গায়ে মেখে, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যসকে মোকাবেলা করে দীর্ঘ সংগ্রামে পথ বেয়ে জাতির জনকের কন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারের অবরুদ্ধ পথ অবমুক্ত করতে সক্ষম হন এবং স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড প্রদানের রায় ঘোষিত হয়। ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে এ বিচার প্রক্রিয়া আবারো বাধাগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতি তার পিতা হত্যার কলঙ্ক হতে মুক্ত হলেও জাতির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সম্ভাবনার দীর্ঘ সময়টুকু।

১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাস। সেই দিনের কিছু স্মৃতিকথা আজ আমি নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে তুলে ধরতে চাই। ‘বাংলাদেশ জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ এর ব্যানারে চট্টগ্রামে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। স্থানীয় মুসলিম হলে ১৭-১৯ আগষ্ট তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন হবে ঠিক হল। তপন বৈদ্য ছিলেন এ সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহবায়ক আর আমি ছিলাম যুগ্ম আহবায়ক। ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকেরই এ সম্মেলনে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এ ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। কথা ছিল, সম্মেলনের প্রত্যেক দিন একটি করে তিন দিনে মোট তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। আর, নাটক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। জাতীয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার উন্নয়নে জাতির জনকের জ্যেষ্ট পুত্র শেখ কামাল ছিলেন অন্তপ্রাণ। আমাদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে আমরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শেখ কামাল সাহেবকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলাম। ১৪ আগষ্ট সন্ধ্যায় আমরা আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই, তার সাথে আমাদের সম্মেলন প্রস্তুতির নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি আমাদেরকে সম্মেলনের খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন এবং রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এরপর আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবি চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদেরকে পর দিন সকালে তার বাসায় যেতে বলেন। সর্বশেষে আমরা তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। কাশেম চিশ্তী সাহেবও সে দিন আমাদের সাথে ছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে আমরা সম্মেলনের উদ্বোধক বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ১৭ তারিখে আমাদের সম্মেলনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করার ব্যাপারে আমাদেরকে শতভাগ আশ্বাস প্রদান করেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের নন্দনকানস্থ বাসা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছাই যখন, তখন রাত একটা। বেশকিছু কুকুর এক সাথে কান্নার রোল তুলে ডাকছিল। মনটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠল, কেমন যেন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল শরীর মন। তাছাড়া মুরব্বীদের মুখে শুনেছি, কুকুরের কান্না নাকি অশুভ লক্ষণ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপন বৈদ্য বলল, দেশে কোথায় কোন অঘটন ঘটতে চলেছে কে জানে? কুকুরগুলো এভাবে কান্না করছে কেন? আমি সান্তনা দিয়ে বললাম, ওসব কিছুই না। এগুলো সব মুরব্বীদের বলা কুসংস্কার। তারপর আমরা ঘুমোতে যাই। সকালে ওঠে ডিসি সাহেবের বাসায় যাব এমন সময় লেয়াকত নামের জাসদ সমর্থক এক ছাত্র আমাকে জানাল বঙ্গবন্ধুকে নাকি ভোর বেলায় হত্যা করা হয়েছে। আরেকটু পর আরেক ছাত্রনেতা গোলাম মোহাম্মদও একই কথা বলল। আমি তাদের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্যারেড কর্ণারের পূর্বপাশে খালেকের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠালাম। বললাম, তোমাদের রেডিওটা অন কর। রেডিও অন করতেই খুনিদের ঘোষণা শুনতে পেলাম। তবুও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এসব কিছু স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার।

আমরা দ্রুত মতিন বিল্ডিংয়ের ছাত্রলীগের অফিসে গেলাম। সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সরফরাজ খান বাবুল, সন্দ্বীপের রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ির আনোয়ারুল আজিম, শওকত হোসেন, মান্নান, ইসমাইল, কাশেম চিশ্তী, পটিয়ার এমএ জাফর, শামসুজ্জামানসহ বিশ পঁচিশজন ছাত্রনেতাকে এক সাথে পেলাম। তৎক্ষনাত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেসি দে রোড, টিএন্ডটি অফিস, লালদীঘি হয়ে রেয়াজ উদ্দীন বাজার আমতল, তিনপুলের মাথা হতে ঘুরে শহীদ মিনার হয়ে পুনারায় পার্টি অফিসে আসি। কোথাও কোন বাঁধা পাই নি। রাস্তায় তেমন কোন মানুষজন কিংবা পুলিশও ছিল না। সবদিকে কেমন জানি শুনশান নিরবতা। তপন বৈদ্যর বাসা ছিল ফকির হাট। মিছিলের পর আমরা তার বাসায় যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের সামনে নামলাম ও স্টেশনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বক্তব্য রাখার সুযোগ চাইলাম। রেডিও কর্তৃপক্ষ রাজী হলেন না। তারপর তপন বৈদ্যর বাসায় চলে যাই। বাকশাল সাধারণ সম্পাদকের সাথে জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর জন্য নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই ঢাকায় ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঢাকার সাথে সারাদেশের সমস্ত যোগাযোগ মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিকেলে আমরা আবারো বেরিয়ে পড়ি। মুক্তিযোদ্ধা চেঙ্গিস খানের শ্বশুরের কাজীর দেউড়িস্থ বাড়ীর সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়জন কথা বলছিলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে দেখলাম সামরিক বাহিনীর কিছু গাড়ী রাস্তায় বেরিয়ে পথচারীদের হুমকি, ধমকি দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। আমরা রাস্তার পাশ ছেড়ে কিছুটা ভেতরে গলির দিকে ঢুকে পড়লাম। আমাদের মধ্যে কাশেম চিশ্তীর বাসা ছিল চাক্তাই। আমরা সবাই যে যার বাসায় চলে গেলাম।

১৭ আগষ্ট সকালে চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেল থেকে রাউজানের সালাম ও বাবুল আমাদের বহরদার বাড়ীর বাসায় আসে পরবর্তী করনীয় বিষয়ে আলোচনা করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী ও কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করতে লাগলাম।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসএম ইউসুফ ভাই (মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর জেলা প্রধান) আমার বাসায় আসলেন। বললেন, চল বাইরে যাব। মাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম (মা অবশ্য বাঁধা দিয়েছিলেন, তবুও) দুজনে। ইউসুফ ভাই আমাকে জামালখানস্থ নজরুলের বাসায় রেখে কোথায় জানি চলে গেলেন। সেই রাতে নজরুলের বাসায় রয়ে গেলাম। সকালে সাতকানিয়ার মুনিরের মারফত ইউসুফ ভাই খবর পাঠালেন। বললেন, তিনি আসবেন। সারা দিন অপেক্ষায় ছিলাম, রাত দশটার দিকে আবারো মনির এসে আমাকে তার সাথে বের হতে বললেন। বললেন, ইউসুফ ভাই আমাদের জন্য অভয় মিত্র ঘাটে অপেক্ষা করছেন। অভয় মিত্র ঘাটের একটি ফিশিং বোটে আনোয়ারুল আজিম, গোলাম রাব্বানী, মো. সেলিম, শওকত হোসেন, রফিক, মনির, কাজী আবু তৈয়ব, মহিউদ্দিন রাশেদ, শামসুজ্জামান, জাফর, দেলোয়ার, মান্নানসহ আমরা ১৪জন ইউসুফ ভাইয়ের সাথে বসলাম। ইউসুফ ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে করনীয় সম্পর্কে আমাদের উদ্দেশ্যে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান।

এ বৈঠকের ঠিক ১৫ দিন পর আমরা নিউ মার্কেট মোড়, আগ্রাবাদ, কাজীর দেউরীসহ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি জায়গায় গ্রেনেড চার্জ করি। এরপর ইউসুফ ভাইসহ কাজী আবু তৈয়ব ও আমি আমাদের নেতা মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই। শক্তি সংগ্রহের জন্য ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে মান্নান ভাইকে বুঝিয়ে বলি। মান্নান ভাই এতে রাজী হলেন না। কিন্তু ইউসুফ ভাই ঠিকই ভারতে চলে গেলেন। এ দিকে কঠোর বিধি নিষেধের যাঁতাকলে পড়ে কোথাও জড়ো হওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ল। তখন নিউমার্কেটে নজরুলের শাহ আমান স্টোর হয়ে উঠল আমাদের যোগাযোগের অন্যতম ক্ষেত্র। এখানে আমরা ক্রেতাবেশে আসতাম ও পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করব। ছাপানোর দায়িত্ব ছিল ফটিকছড়ির এসএম ফারুকের উপর। যথারীতি লিফলেট ছাপানো হল, বিভিন্ন জায়গায় বিতরন করা হল। এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে আমরা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকলাম। নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ আমরা জানতে পারলাম, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কারাগারের ভেতর ঢুকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। সে দিন মুক্তি যোদ্ধা নুরুল বশর ও আমি আমাদের বহরদার বাড়ীর বাসা থেকে বেরিয়ে কাজেম আলী স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে লিয়াকত (পরবর্তী কমিশনার) ও আওয়ামী লীগ কর্মী ফোরক আহমদের সাথে দেখা হয়। চার জন মিলে আলাপ করলাম কি করা যায়! লিয়াকত বলল, চল আমরা চট্টগ্রাম কলেজ গিয়ে প্রতিবাদী মিছিল বের করি। যদিও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই ১৯৭২ সালে, সম্মেলন না হওয়ায় তখনো আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে আছি। আমরা কয়েক জন দ্রুত কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাম আর গ্যালারী ২ তে গিয়ে বললাম ক্লাস হবেনা। শিক্ষক আবু তাহের সাহেব তা মানতে রাজী হলেন না। লিয়াকত ক্যাম্পাসের এ দিক সে দিক ছুটোছুটি শুরু করেছে, একজন ছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে আয়নায় সজোড়ে একটি পাথর ছুঁড়ে মারল। বিকট আওয়াজ আর কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা দিগ্বিদিক ছুটতে আড়ম্ভ করল। তারপর, প্রতিবাদী ছাত্রদের নিয়ে আমরা মিছিল বের করি ও মহসীন কলেজ, কাজেম আলী স্কুল ও খাস্তগীর স্কুলের ক্লাশ বন্ধ করে দিই।

এরপর মিছিল নিয়ে আন্দরকিল­া, নজির আহমদ সড়ক, রাইফেল ক্লাব হয়ে শহীদ মিনারে দিকে ঘুরতেই নিউমার্কেটের ঐদিক থেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কয়েকটি গাড়ী এসে আমাদের উপর হামলে পড়ে। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তৎকালীন গ্র্যান্ড হোটেলের গলিতে ঢুকে যাওয়ার পরও দেখি পুলিশ আমার পিছু ছাড়ে নি। পাশ্ববর্তী একটি ভবনের সীমানা প্রাচীর টপকে আমি কোন প্রকারে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলেও অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। রাঙ্গুনিয়ার এমপি মরহুম ক্যাপ্টেন কাশেম সাহেবের একান্ত সহাযোগিতায় পরের দিনই তারা ছাড়া পান। সে দিন বিকেলেই ইউনাইটেড হোটেলের সামনে সিটি কলেজের ছাত্রনেতা জানে আলমের সাথে আমাদের দেখা হয়। হোটেলের কাছেই জানে আলমের বাসা। হোটেল মালিকের শ্যালক যখন বললেন, কক্সবাজারের গোলাম রাব্বান ভাই হোটেলে আছেন তখন আমরা হোটেলের এক কোনার গোপন আস্তানায় তার সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আমরা সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করব তোমরা দ্রুত প্রস্তুতি নাও।

চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে এসেবেয়ারা বশরকে ৫০ টাকা দিয়ে বাঁশ, চট ও কেরোসিন আনতে পাঠালাম। কিছু পরে হোস্টেলের আরেক বেয়ারা চিত্ত এসে বলল মশালের সরঞ্জামসহ বশর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আমাদের মশাল মিছিলের পরিকল্পনা এখানে ব্যর্থ হল। এরপর রাব্বান ভাইসহ আমরা পরের দিন হরতাল কর্মসূচী ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফেনীর গোলাম মোস্তফার সাথে যোগাযোগ করলাম। তার একটা ছাপখানা ছিল, এখান থেকে হরতালের সমর্থনে লিফলেট ছাপানো হল। সারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঐ লিফলেট বিতরণ করা হল। মুত্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল বশর ও আমি বহরদার হাট, মুরাদপুর, চকবাজার, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও এলাকার দায়িত্ব নিয়ে লিফলেট বিতরণ করি। হরতাল হয় নি, পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের অনুকুলে ছিল না সেটাতো বুঝতেই পারছেন। আমরা বিচ্ছিন্ন কর্মসূচী দিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে আস্তে আস্তে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছিলাম মাত্র। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, মহানগরীর বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে প্রতিবাদী কর্মসূচী দিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাই।

সে দিনের কথা মনে হলে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। রাতারাতি সবকিছু যেন বদলে গিয়েছিল তখন। চেনা মানুষগুলোর অনেকেই যেন অচেনা হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু থাকাকালীন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লোকগুলো, যাদের সাথে আমাদেরও বেশ সখ্যতা ছিল, আজ তার রঙ বদলে নিয়েছে গিরগিটির মত। তাদের কাছে গেলে তারা আমাদের দূর দুর করে তাড়িয়ে দিতে লাগল। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা কটুক্তি করতেও ছাড়ে নি তারা। তাদের এ কটু আচরণ, স্বৈরাচার ও স্বাধীনতা বিরুধী অপশক্তি ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ জাতীয় চারনেতা হত্যাকান্ডের বেনিফিশিয়ারী গোষ্ঠীর অত্যাচার, নিপীড়ন, প্রলোভনকে পদদলিত করে জীবনবাজী রেখে আমরা মুজিবপ্রেমী জনগন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ন্যাস্ত করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু, বর্ণচোরা গিরগিটির দল আবারো আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্র ক্ষমতার নানা স্তরে জেঁকে বসেছে। নিজেদের প্রভাব বলয়ের বিস্তার ঘটাতে প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে অবস্থানকারী স্বাধীনতা বিরোধীদেরকেও মুজিবাদর্শের সৈনিক আখ্যা দিয়ে প্রকৃত মুজিপ্রেমীদের কোনঠাসা করে রাখায় অপপ্রয়াসে লিপ্ত।

তারা আজ ভাবতে শুরু করেছে, সংগঠনে তারাই শক্তিশালী। তাই, তারা অসম্ভব রকমের বেপরোয়া। এদের আস্ফালন ও বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ট হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগের অনুসারীরা রাজনীতি কর্মকান্ডের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তাদের অভিমানী মন আজ রাজনীতি বিমূখ। এর থেকে ফায়দা লুটছে সুবিধাবাদীরা, তারা ক্ষমতার সুযোগে দিনের পর দিন অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিক হচ্ছে। আর এ অর্থের দাপটে আদর্শিক কর্মীরা আজ ক্ষত বিক্ষত।

তাই শোকের মাসে ডাক দিয়ে যাই, আসুন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা। আর হতাশা নয়, অভিমান নয়। সুবিধা বাদীদের হটিয়ে, তাদের সব চক্রান্তকে পদদলিত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝান্ডা উড়াই। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে আমরা ঋণী। আমরা দায়বদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক, ইতিহাসের শ্রেষ্ট সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণের কাছে। আসুন, জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অভিযাত্রাকে কন্টক মুক্ত করতে ও জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী রাখতে কাজ করে যাই।

সকলকে ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।