বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি: বাড়ছেই মৃত্যু, করতোয়ার তীরের দৃশ্য হৃদয়বিদারক

সোমবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২

প্রিন্ট করুন

বোদা, পঞ্চগড়: পঞ্চগড় জেলার করতোয়া নদীতে রোববারের (২৫ সেপ্টেম্বর) নৌকাডুবির ঘটনায় সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর বিকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ জনে। ডুবে যাওয়া শতাধিক যাত্রীবাহী ওই নৌকাটির আরো অনেক যাত্রী এখনো নিখোঁজ আছে। যদিও নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে করতোয়া নদীর তীরে তৈরি হয়েছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন বোদা উপজেলার বটতলী গ্রামের হরিকিশোর ও কণিকা রানী দম্পতি। তাদের দুই সন্তান অজয় কুমার ও উজ্জ্বল কুমার রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর থেকেই নদীর পাড়ে বাবা-মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অজয়ের বয়স ১৪ আর উজ্জ্বলের বয়স ২২। বার বার মূর্ছা যাচ্ছে তারা।

তাদের মামা রিপন অধিকারী বলেন, ‘দুই ভাই বাবা-মায়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উজ্জ্বলকে এখন স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।’

রিপন অধিকারী আরো বলেন, ‘মহালয়ার অনুষ্ঠান দেখার জন্য তার বোন ও বোনের স্বামী তাদের পরিবারের আরো পাঁচজন অর্থাৎ মোট সাত জন ওই নৌকাতে ছিল। কিন্তু একজন সাঁতার কেটে উঠে এলেও বাকি ছয়জন এখনো নিখোঁজ। এদের মধ্যে অজয় ও উজ্জলের বাবা-মা রয়েছেন।’

রিপন অধিকারী বলেন, ‘আমার বোন (কণিকা রানী) আমাকে বলেছিল, ‘চল, এক সাথে যাই, মহালয়ার অনুষ্ঠান দেখে আসি।’ আমি বলেছিলাম, এখন যাব না, পরে যাব দুই ভাগনাকে সাথে নিয়ে। তোমরা যাও। এ বলে আমি ঘরে শুয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই শুনি নৌকা ডুবে গেছে।’

‘আমি দৌঁড়ে গেলাম নদীর পাড়ে। দেখলাম, নৌকাটা যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ডুবে গেছে। আমার পরিবারের সাতজন ছিল। আমার আরেক বোনের স্বামী উঠে আসতে পেরেছে বাকিদের এখনো পায় নি।’

তিনি বলছিলেন, ‘আমার দুই ভাগনা ওদের বয়স কম, কাল থেকে নদীর পাড়ে বসে আছে। কান্না-কাটি করতে করতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছে। অজয়কে ওষুধ দেয়া হয়েছে। আর উজ্জলের স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।’

লাশের জন্য অপেক্ষা: করতোয়া নদীর পাড়ে নিখোঁজ স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছেন অনেকে। তাদের মধ্যে গ্রি বাবু একজন। তার পরিবারের দুইজন মারা গেছেন, আর দুইজন এখনো নিখোঁজ।

গ্রি বাবু বলেন, ‘আমার শ্যালক ও তার বোন এখনো নিখোঁজ। আর আমার স্ত্রীর মামী ও খালার মরদেহ গতকালকেই (রবিবার) পাইছি। এখন আমি বাড়ি টিকতে পারছি নে। এ নদীর পাড়ে বসে আছি, যদি বাকি দুইজনের কোন হদিশ পাওয়া যায় সেই আশায়।’

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় ট্রলার ডুবে নিহত নারী ও শিশুসহ এ পর্যন্ত ৩০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে দমকল বাহিনী। এদের মধ্যে ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর)। বাকি ছয় জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত। এ নৌকাডুবিতে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা আছে।

নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা উল্লেখ না করলেও দমকল বাহিনীর উপসহকারী পরিচালক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে নিখোঁজ আছেন।’

বোদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সোলেমান আলী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, সেটার সঠিক হিসেব দেয়া যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, একজন নিখোঁজ আছে, তার কথা এসে একাধিক ব্যক্তি বলে যাচ্ছেন আমাদের কাছে। সুতরাং বেশ কয়েকটি তালিকায় একই ব্যক্তির নাম আসছে। ফের কেউ হয়ত সাঁতরে উঠে এসেছেন, কিন্তু অন্য আরেকজন জানেন না। তিনি এসে নিখোঁজের তালিকায় নাম দিয়ে যাচ্ছেন। এখন আমরা সব তালিকা করে যাচাই করে দেখছি, ঠিক কতজন নিখোঁজ আছেন।’

মহালয়ার অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছিলেন সবাই: রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) করতোয়া নদীতে দুপুর সোয়া দুইটার দিকে আনুমানিক ১০০ জনের বেশি যাত্রী নিয়ে ওই ট্রলারটি ডুবে যায়। দমকল বাহিনীর উদ্ধারকর্মী ও ডুবুরিরা নদীতে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া আউলিয়া ঘাট নামক জায়গায় এ ঘটনাটি ঘটেছে। আউলিয়া ঘাটের অপর পাশেই রয়েছে বদেশ্বরী মন্দির। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব মহালয়া পালিত হয়েছে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর)।

প্রাচীন ওই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে প্রতি বছরই অনেক বড় অনুষ্ঠান হয় ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে সনাতন ধর্মের বহু মানুষ এতে যোগ দেন। করতোয়া নদীতে সারা বছরই পানি থাকে এবং এ নদীর ওপর কোন সেতু নেই। ফলে নদী পারাপারের জন্য নৌকা ও ট্রলারই ভরসা। ফলে প্রতিদিনই নৌকা ও ট্রলার চেপে শত শত মানুষ পার হয়ে পড়াশুনা ও কর্মস্থলে যান।

বিবিসি/সিবিএনটিভিইউএসএ/এমএ