ঢাকা: নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সরব হয়ে ওঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গণতন্ত্রের সবক দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলে সমালোচিতও হন। তবে, নির্বাচন শেষে অনেকটাই ইউটার্ন নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সুর বদলেছে পিটার হাসেরও। নিজ স্বার্থ হাসিলে অনেকটাই কৌশলী ভূমিকায় নেমেছেন তিনি।
নির্বাচনের পর বিভিন্ন মন্ত্রীর দফতরে গিয়ে আগামী দিনে একসাথে কাজ করার কথা বললেও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়ে খেলছিলেন তিনি।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে একসাথে কাজ করারও আগ্রহ প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে, চিঠিতে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে কোন মন্তব্য করেননি বাইডেন। টানা চতুর্থ বারের মত প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় শেখ হাসিনাকেও শুভেচ্ছা জানিয়ে কিছু বলেননি তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচনি ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রেখে বিভিন্নভাবে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র। আর পিটার হাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের স্বার্থ হাসিলের প্রেসক্রিপশন মেনেই কাজ করবেন।
এ চিত্রই যেন উঠে আসে মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের সাথে পিটার হাসের সাক্ষাতে। অন্য মন্ত্রীদের কাছে নির্বাচন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও এ দিন তিনি নির্বাচন নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। উল্টো বোয়িং বিক্রি করতে এক রকম আবদার জানিয়ে এসেছেন।
পরে, মন্ত্রী ফারুক খান বলেন, ‘নয়া উড়োজাহাজ কেনার ব্যাপারে ফ্রান্সের এয়ারবাসের সাথে এরমধ্যে চুক্তি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং থেকেও বিমান কিনতে পারে বাংলাদেশ।’
তিনি জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নয়া উড়োজাহাজ কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি বোয়িং তার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। আমরা চাই, বোয়িং যেন এ উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও প্রক্রিয়াটি যেন একটি স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কেন ইউটার্ন: নির্বাচনের পূর্বে ও পরে মার্কিনিদের বিপরীতমুখী আচরণের কারণ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জাপান-ভারতের ন্যায় বড় গণতান্ত্রিক দেশ শুভেচ্ছা জানানোয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছে না মার্কিনিরা। পাশাপাশি, ফিলিস্তিনে গণহত্যায় ইসরাইলকে সমর্থন জানানোয় নৈতিক শক্তি হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পূর্বেও বিভিন্ন দেশে একটি দলের বিরোধিতা করার পর সরকার গঠন করায় তার সাথে কাজ করার নজির রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।’ পাশাপাশি, নতুন সরকারের সাথে বিরোধ রেখে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চায় না মার্কিনিরা। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মোড়কে হলেও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপগুলোর পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থই প্রধান বলে মত ইমতিয়াজের। ভিসানীতি প্রয়োগ বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
কেন বোয়িং বেচতে চায় যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্র কেন বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ বেচতে চায়? জানতে হলে ফিরতে হবে পেছনে। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড কোম্পানি হলে বোয়িংয়ের সাথে উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি হয়। এগুলো আসতে থাকে ২০১১ সাল থেকে। সবশেষ ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪টি উড়োজাহাজ কেনা হয় বোয়িংয়ের কাছ থেকে। ২০১৯ সালে দুটি আনা হয় ভাড়ায়। বর্তমানে বিমানের বহরে থাকা ২১টি উড়োজাহাজের মধ্যে ১৬টি বোয়িং আর বাকি পাঁচটি ড্যাশ- এইট উড়োজাহাজ। গেল সেপ্টেম্বরে ভারতে জি-২০ বৈঠক শেষে ঢাকা সফর করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ৩৩ বছর পর ফ্রান্সের কোন প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে অন্যান্য বিষয়ের সাথে চুক্তি হয় এয়ারবাস কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কেনার। তারপর থেকেই ব্যবসায় হারানোর ভয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের। গেল ৫ ডিসেম্বর বিমানের সাথে বৈঠক করলেও বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে রেখেছে গেল মে মাসেই। তবে, এর পূর্বেই প্রস্তাব ছিল এয়ারবাসের। এছাড়া, ভিসানীতির ভীতিতে কাজ না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নাকের ডগায় এবার ঝুলিয়ে দিয়েছে পোশাক খাতে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল কোয়াডে যাওয়ারও। কিন্তু, কোন সামরিক জোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অনড় থাকলে সফল হয়নি মার্কিনিদের সে চেষ্টাও।
নিজেরটা ষোল আনা বোঝে মার্কিনিরা: ব্যবসায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা যখন কাজ করছে, তখন নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যে ভূ-রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বক্তব্য এক দিকে, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক বিষয়টা আরেক দিকে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে, যারা এ নির্বাচনকে সাধুবাদ জানিয়েছে। নির্বাচনের পরপরই তারা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে।’ এ অধ্যাপক বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বক্তব্য ছিল যে, এটি সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু, একই সাথে তারা বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয়, সরকার যেসব দেশের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা শুরু করবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কতখানি ঢুকতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ঢোকাটা একটু কঠিন হবে।’ অধ্যাপক ইমতিয়াজ মার্কিনিদের এমন আচরণের ব্যাপারে বলেন, ‘এ দেশে গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে আসেননি পিটার হাস। তিনি নিজ দেশের স্বার্থই দেখছেন। নির্বাচনের পূর্বে পিটার হাস যেসব কথা বলেছিলেন, তাও নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই বলেছেন। মূলত তাদের জাতীয় স্বার্থই এখানে আসল।’ যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের নিজের স্বার্থ হাসিলে আগ্রহী উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সরকার ও রাজনীতির বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইখতিয়ার উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আজকে এক দিক দিয়ে ভাল সম্পর্ক রাখবে, কালকে হয়তো অন্য দিক দিয়ে চাপ দিবে।’ ‘বাংলাদেশে আজকে তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছে। যেমন শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে।’ যোগ করেন তিনি। জাবির এ শিক্ষক বলেন, ‘চাপ প্রয়োগ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য কমাতে চায় ও এটা কমানোর জন্য তারা এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসে।’ ‘আসল কথা হল ছলেবলে কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র চায় নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে। এ জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর উচ্চস্বরে আওড়ায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার কিংবা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বুলি।