বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে পুরো দেশে অন্তত ৩৪ প্রার্থীর ভোট বর্জন

রবিবার, জানুয়ারী ৭, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: সমাপ্ত হল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল আটটায় শুরু হয়ে ভোট চলে বিকাল চারটা পর্যন্ত। ভোট গ্রহণ শেষে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে পুরো দেশে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ২৯৯ আসনে ভোট চলাকালীন গোটা দিনে নানা স্থানে গোলাগুলিসহ সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রতিপক্ষের হামলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছে বহু। এ ছাড়া, নানা কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, পূর্বেই নৌকার ব্যালট পেপারে সিল মেরে রাখা, এজেন্ট বের করে দেয়া, ভোটে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামে একটি আসনের নৌকার প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এসব ঘটনাবলির মধ্যে নানা কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগে ভোট বর্জন করেছেন ৩৪ প্রার্থী। তাদের অধিকাংশই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন।

ভোলা-তিন: কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়া ও ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে এই আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব.) মো. জসিম উদ্দিন ভোট বর্জন করেছেন। দুপুরে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তিনি এ ঘোষণা দেন। বার্তায় জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সরকার ও নির্বাচন কমিশন একটি অংশগ্রহণমূলক ও আনন্দমুখর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আজ সকাল থেকে নানা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, কোন ভোটার নেই। কেন্দ্রের বাইরে নৌকার কিছু লোক দাঁড়িয়ে থেকে তারাই বার বার ভোট দিচ্ছে। ভোটার না থাকার কারণ হল ভোটারদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, যাতে তারা কেন্দ্রে না আসে।’ একইসাথে তিনি অভিযোগ করেন, ‘ভোটারদের ভয়ভীতির ব্যাপারে একাধিক অভিযোগ করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যার কারণে প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোট প্রকাশ্যে নেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে ভোট নেয়াটা একটা প্রহসনের নির্বাচন। তাই, এ প্রহসনের নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ ভিডিও বার্তায় নির্বাচন বাতিল করে সরকার ও নির্বাচন কমিশনারের কাছে পুনরায় নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান তিনি।

কুমিল্লা-এক: আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের নাঈম হাসান ও জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের আমির হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনে তারা ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন।

কুমিল্লা-১১: ভোট বর্জন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান। তিনিও সংবাদ সম্মেলনে ভোটের পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ করেন।

কুমিল্লা-সাত (চান্দিনা): সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জন করেছেন এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের মুনতাকিম আশরাফ টিটু। তিনি চান্দিনার ৮৯টি কেন্দ্রেই জালভোটের অভিযোগ তুলেছেন। এ ব্যাপারে কুমিল্লার এনডিসি কানিজ ফাতিমা বলেন, ‘প্রার্থীদের কেউ আমাদের লিখিতভাবে ভোট বর্জনের কথা জানায়নি। তবে, একজনকে ভোট বর্জন করতে ভার্চুয়ালি দেখেছি।’

পাবনা-দুই: এই আসনের (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী ভোট বর্জন করেছেন। তার অভিযোগ- জালভোট, নৌকার সিল দেখিয়ে নৌকায় ভোট দেয়া ও কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোটারদের নৌকা প্রতীকে সিল দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি নিজে হাতেনাতে কয়েকটা ধরেছি। ধরে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে অভিযোগ‌ দিয়েও কোন প্রতিকার পাইনি। এরপর ভোট বর্জন করেছি।’ সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা সুখময় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার কাছে উনি কোন অভিযোগ দেননি। অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট হচ্ছে। উনি অভিযোগ দিলে তদন্ত করে দেখা হবে।’

বাগেরহাট-চার: এজেন্টকে মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ তুলে দুপুরের দিকে ভোট বর্জন করেছেন বাগেরহাট-চার আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এমআর জামিল হোসাইন। রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘শরণখোলার রায়েন্দা ইউনিয়নের কদমতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট চলাকালীন নৌকার সমর্থকরা তার এজেন্টকে মারধর করে বের করে দিয়েছে। এ ছাড়া, নানা কেন্দ্রে জালভোট, কর্মীদের মারধর ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেন তিনি। জানতে চাইলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রার্থীর অভিযোগ পাওয়ার পর সাথে সাথে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে ও নিজে খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগের সত্যতা পাননি।’ এ ব্যাপারে কদমতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, ‘প্রার্থী জামিল হোসাইন প্রথমে সাতজন এজেন্টের তালিকা দিয়ে যান। কিন্তু, তারা কেউ না আসায় ব্যাপারটি প্রার্থীকে জানানো হয়। পরে তিনি নিজে এসে তার এজেন্টকে ফোন দিয়ে না পেয়ে নতুন তিনজনের নাম দিয়ে যান। তারা কিছুক্ষণ থাকার পরে ভোট বর্জনের কথা শুনে ওই তিনজনও পরে নিজ ইচ্ছায় চলে যান।’

কক্সবাজার-তিন: ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা মিজান সাঈদ ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

কক্সবাজার-চার: এই আসনে ভোট বর্জন করা দুই প্রার্থী হলেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল বশর ও লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল আমিন সিকদার ভূট্টো।

কক্সবাজার-এক: চকরিয়া-পেকুয়া নিয়ে গঠিত এই আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সাংসদ জাফর আলম ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, ভোটে অনিয়ম এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ। তবে, প্রার্থীদের প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-তিন: ভোট গ্রহণে কারচুপির অভিযোগে এই আসনে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিএনএমের প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল মতিন। ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দেয়া হলেও ভোটের দিন চিত্র পুরো উল্টো ছিল। বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। আরো কয়েকটি কেন্দ্রে দায়িত্বরত এজেন্টদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়েছে। পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে তাকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি নৌকার সমর্থকরা। এ অবস্থায় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় ভোট বর্জন করেন তিনি। তার ভোট বর্জনের আগে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলার প্রশাসক একেএম গালিভ খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পুরো জেলায় সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

নরসিংদী-দুই: এই আসনের জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এএনএম রফিকুল আলম সেলিম সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘ভোটগ্রহণ শুরু হলে নানা কেন্দ্রে অনিয়ম ও ভোট কারচুপি শুরু হয়। এমনকি নৌকার সমর্থকরা নানা কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে আমি আর ভোটে থাকতে পারছি না। আমি এই মুহূর্তে ভোট বর্জন করলাম।’

নড়াইল-দুই: কেন্দ্রে ভোট গ্রহণে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছেন এই আসনের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি মনোনীত হাতুড়ি প্রতীকের প্রার্থী শেখ হাফিজুর রহমান। দুপুরের দিকে নড়াইল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনসহ ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন তিনি।

যশোর -এক (শার্শা): নানা কেন্দ্রে হামলাসহ ৫৫টি কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া ও প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগে এই আসনের ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম লিটন ভোট বর্জন করেছেন। দুপুরে তার নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘোষণা দেন তিনি।

মৌলভীবাজার-দুই (কুলাউড়া): তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী এম‌এম শাহীন নির্বাচনে কারচুপি ও পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অভিযোগে শাহীন বলেন, ‘কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনিয়ম ও জালভোট দেয়া হয়েছে। প্রায় সব কেন্দ্র থেকেই এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট চলাকালীন এসব অনিয়মের কথা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করার পর‌ও কোন প্রতিকার না পাওয়ায় ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

কুড়িগ্রাম-চার: এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান বঙ্গবাসী ও লাঙ্গল প্রতীকের একেএম সাইফুর রহমান অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন।

এ ছাড়া, নড়াইল-১-এ একজন, পাবনা-চার (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস, ঠাকুরগাঁও-এক আসনের জাতীয় পার্টির রেজাউর রাজি স্বপন, বগুড়া- ৪-এ একতারা মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম, ঢাকা-২-এ ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাক্তার হাবিবুর রহমান, চাঁদপুর-৪-এ জাতীয় পার্টির সাজ্জাদ রশিদ, নারায়ণগঞ্জ-২-এ জাতীয় পার্টির আলমগীর শিকদার, সিলেট-দুই আসনে গণফোরামের মোকাব্বির খান, স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিবুর খান, জাপার ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া, তৃণমূল বিএনপির মো. আব্দুর রব, সিলেট-৩-এ স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ডাক্তার ইহতেশামুল চৌধুরী দুলাল, জাপার আতিকুর রহমান আতিক, সিলেট-৪-এ তৃণমূল বিএনপির আবুল হোসেন নানা, কুমিল্লা-১০-এ জাপার জোনাকি মুন্সি, জামালপুর-তিন আসনের জাপার মির শামসুল আলম অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন।