মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ভ্রমণ/ইস্তানবুলের পথে প্রান্তরে

সোমবার, মে ২০, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

মো. মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু: বিশ্বের কয়েকটি প্রাচীন শহর রয়েছে, তার মধ্যে তুরষ্কের ইস্তানবুল শহর অন্যতম। এ শহরটি সম্পর্কে জানা-শোনা আমার বহু বছরের। প্রায় এক যুগ পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক বার তুরষ্কে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও বিভিন্ন জটিলতায় যেতে পারি নাই। সেই দিন থেকে মনের মধ্যে ইস্তানবুল, আংকারা শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। আল্লাহ অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ করার তৌফিক দিয়েছেন এবার। ঈদুল ফিতরে মায়ামী থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম এবং টার্কিশ এয়ারলাইন্সে টিকিট কেটে ৩ মে ঢাকা থেকে ফেরার পথে প্রায় ১৩ ঘন্টা যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে। এ সুযোগে এ শহরটিকে একটু ঘুরে দেখলাম। এ দিনব্যাপী ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করব।

ইতিহাস: খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে শহরটি মেগারা থেকে আসা গ্রীক বসতি স্থাপনকারীরা বাইজান্টিয়াম নামে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট এটিকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন, প্রথমে এটিকে নয়া রোম ও তারপর নিজের নাম অনুসারে কনস্টান্টিনোপল (কনস্টান্টিনোপলিস) নামকরণ করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে শহরটি বিস্তৃতি লাভ করে ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়, সেইসঙ্গে সিল্ক রোডের ও ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে।

শহরটি প্রায় ১৬০০ বছরের বেশি সময় একাধারে রোমান/বাইজান্টাইন (৩৩০-১২০৪), ল্যাটিন (১২০৪-১২৬১), শেষ বাইজেন্টাইন (১২৬১-১৪৫৩) এবং অটোমান (১৪৫৩-১৯২২) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল পতনের মাধ্যমে উসমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোমান/বাইজেন্টাইন সময়ে খ্রিস্টধর্মের অগ্রগতিতে এ শহরটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২৩ সালে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করা হয়। যদিও আঙ্কারা শহরটি তুরস্কের প্রশাসনিক রাজধানী হলেও ইস্তাম্বুল আজো দেশটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। ১৯৩০ সালে শহরটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল রাখা হয়, যা ১১ শতক থেকে গ্রীক ভাষাভাষীরা কথোপকথনে শহরটিকে বোঝাতে ব্যবহার করত।

ই ভিসা: যাদের এরমধ্যে সেনজেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডের ভিসা আছে, তারাই এই ওয়েবসাইটে https://www.evisa.gov.tr/en/) গিয়ে ৬০ ডলার পরিশোধ করে খুব সহজেই ই ভিসা নিতে পারবেন। অথবা শুধুমাত্র ক্যাশ দিয়ে ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট থেকেও নিতে পারবেন। আমি বাংলাদেশে থাকাকালীন ই ভিসা করে নিয়েছিলাম, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত ছিল।

টার্কিশ এয়ারলাইন্সের যে সব যাত্রীর যাত্রাবিরতি ৬-২৪ ঘন্টার মধ্যে, তাদের জন্য কমপ্লিমেন্টরি ট্যুর ইস্তানবুল নামে একটি প্যাকেজ আছে। আমি এ প্যাকেজ নিয়েছিলাম। বিকাল চারটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি ইস্তানবুল শহর।
একজন দক্ষ গাইড আমাদের সকলকে নিয়ে একটি বাসে করে রওয়ানা দেই। ৪০-৫০জনের একটা গ্রুপ হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তানজিম নামে এক বাংলাদেশী ভাইকে পেয়েছিলাম। উনি জার্মানি থাকেন। যা হোক, আমাদের বহনকারি বাস ৪০ মিনিট পর ইস্তানবুল শহরে পৌছায়। পথিমধ্যে আমাদের গাইড মি ওকান বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা দেন। ইস্তানবুলের ঘর বাড়িগুলো মোটামুটি একই ডিজাইনের। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

বাস থেকে নেমে আমরা প্রথমে ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যাই। ১৮০০ শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্যাজ্যের সময়ে নির্মিত মসজিদ নুরুওসমানিয়ে মসজিদ। মসজিদের নির্মান শৈলী মুগ্ধ করবে সকলকে। মার্বেল পাথরের কি নিখুত গাথুনি। মসজিদে যখন ঢুকি, তখন আছরের ওয়াক্ত। তাই, এ সুযোগে ঐতিহাসিক এ মসজিদে দুই রাকআত কছরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ পড়ে দেখি, আমার গ্রুপের সবাই চলে গেছে। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে আমি দুই মিনিট পরে এসেছিলাম। আমার কাছে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। আল্লাহর রহমতে দুই টার্কিশ যুবক আমাদের সাহায্য করেছিল।

আমি গ্রান্ড বাজারের গিয়ে গ্রুপের পুনরায় যুক্ত হই। গ্রান্ড বাজার মূলত আমাদের দেশের গুলিস্তান মার্কেটের মত। কি নাই এখানে, গার্মেন্টস, জুয়েলারি, জুতাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দোকান রয়েছে। সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ল মিষ্টির দোকান। বাহারি রকমের মিষ্টান্ন। এখানকার ব্যবসায়ীরা বহু ধুর্ত মনে হল। তাই, সাবধান। প্রায় ৬০০ বছরের পুরাতন এ মার্কেট। এ বাজারের দোকানী বাদে বাকি সকলকে টুরিস্টই মনে হল। বাজার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে চলে গেলাম ডিনারে। বিখ্যাত টার্কিশ কাবাব দিয়ে ডিনার শুরু করলাম। সঙ্গে ছিল পাউরুটি, ভাত, সালাদ, স্পেশাল পানীয়, চাটনি। ডিনার শেষ করে ফের ইস্তানবুলের রাস্তায় বের হলাম। এত মানুষ, আমার মনে হয়েছে, আমি ঢাকার গুলিস্তানেই আছি। আমাদের এবারের গন্তব্য ৬০০ বছরের পুরনো স্থাপনা থিও ডিওসিয়াসের ওবেলিস্ক। এখানে কিছু ছবি তুলতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। এ স্থাপনার পাশেই অবস্থিত বিখ্যাত ব্ল মসজিদ। এটাকে অনেকে সুলতান আহমেদ মসজিদ নামে চিনে। অটোম্যান সামাজ্যের সময়ে ১৬০৯-১৭ সালের মধ্যে আহমেদ-১ এটি নির্মাণ করেন। আমরা যখন এ মসজিদের ভেতরে ঢুকি, তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হল। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। মসজিদের ভেতরের কারুকার্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রায় দশ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। রাতের মসজিদের লাইটগুলো যখন জ্বালানো হল, এক অন্য রকম দেখতে লাগছিল। সুলতান আহমেদ মসজিদের পাশেই অবস্থিত আরেক বিখ্যাত আয়া সোফিয়া। প্রায় ১৬৬৪ বছর পূর্বের স্থাপনা এটি। খ্রিষ্ট্রীয় ধর্মাবল্মবীরা এটাকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর স্থাপনাটি মসজিদে রূপান্তর করেন। ২০১৮ এর ৩১ মার্চ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান কুরআন তিলাওয়াত করে ফতেহ সুলতান মুহাম্মদসহ আয়া সোফিয়ার জন্য কাজ করা সবার রহুের মাগফেরাতে মোনাজাত করেন। ২০২০ এর ১০ জুলাই তুরস্কের শীর্ষ আদালত এটাকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের রায় ঘোষণা করেন। আদলতের রায়ের পর মসজিদে আজান দেয়া হয়েছে ;যা প্রায় ৮৬ বছর পর।

দেখতে দেখতে কখন যে সময় শেষ হয়ে রাত হয়ে গেল টেরই পেলাম না। ইস্তানবুল থেকে এয়ারপোর্টে ফেরার পথে বসফরাস সেতু দেখলাম; যা এশিয়া আর ইউরোপ মহাদেশকে যুক্ত করেছে। পরিশেষে, যারা টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করেন, ইচ্ছা করলে এ ট্যুর ইস্তানবুল প্যাকেজ আপনারাও উপভোগ করতে পারেন। যা হোক, সংক্ষিপ্ত এ সফরে বহু অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম। ইনশাল্লাহ, ফের দেখা হবে ইস্তানবুল।

লেখক: সাধারন সম্পাদক, আটলান্টিস বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস লাইফ অর্গানাজেশন
মায়ামি, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।