বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের নড়বড়ে দশা; বাড়ছে বন্দুক সহিংসতা, হত্যা, পুলিশি নির্যাতন

সোমবার, অক্টোবর ৩, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ডেস্ক রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক বা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র চর্চার দেশ হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতি থেকেই গুম, খুন বা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে সবক দেয়ার বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ‘অধিকার’ হিসেবে বিবেচনা করে কিনা- সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে বন্দুক সহিংসতা, হত্যা, পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা।’ বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষায় ‘সোচ্চার’ দেশটিতে গুমরে মরছে বিচার ব্যবস্থা, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ মার্কিন নাগরিকরাই।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিগত বছরগুলোর তুলনায় আরো খারাপ হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতায় দেশটিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে বন্দুক সহিংসতায় হতাহত বেড়েছে কয়েক গুণ। ‘মিথ্যা গণতন্ত্র’ মার্কিন জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে পদদলিত করছে ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আগ্রাসী আচরণ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।’

এ ছাড়া জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষ করে এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষের প্রতি দেশটির ক্রমবর্ধমান বৈষম্যও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, মার্কিন প্রশাসনের একতরফা কর্মকাণ্ড বিশ্বজুড়ে নতুন মানবিক সংকট তৈরি করেছে।

বন্দুক সহিংসতায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান: যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, অন্য যে কোন বছরের তুলনায় ২০২০ সালে বন্দুক হামলা-সম্পর্কিত ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গুলি করে হত্যার রেকর্ড সংখ্যক ঘটনার পাশাপাশি বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত।

সিডিসি, এফবিআইসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা-সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় ২০২০ সালের। ওই বছর দেশটিতে এ ধরনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫ হাজার ২২২ জন।’

সিডিসি বলছে, ‘বন্দুক হামলায় প্রাণহানির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বছরের পর বছর ধরে বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাই বেশি ঘটে আসছে। ২০২০ সালে দেশটিতে বন্দুক সংক্রান্ত মৃত্যুর ৫৪ শতাংশ ছিল আত্মহত্যা (২৪ হাজার ২৯২ জন), যেখানে ৪৩ শতাংশ ছিল হত্যা (১৯ হাজার ৩৮৪ জন)। এ ছাড়া ওই বছর বন্দুকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ মৃত্যু ৫৩৫, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন মৃত্যু ৬১১ ও ‘অনির্ধারিত পরিস্থিতিতে’ মৃত্যু হয়েছে চার শতাধিক।

২০২০ সালে বন্দুক হামলা-সম্পর্কিত ঘটনায় মারা গেছেন মোট ৪৫ হাজার ২২২ জন, যা এর আগের বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ, পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ ও এক দশক আগের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণহানি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এতে ২০২০ সালে নিহত হন ১৯ হাজার ৩৮৪ জন, যা ১৯৬৮ সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি। ওই বছর বন্দুক হামলায় প্রাণহানি আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৪ শতাংশ, পাঁচ বছর আগের তুলনায় ৪৯ শতাংশ ও দশ বছর আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে।

বন্দুক সহিংসতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার হার অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। যদিও ১৯৫টি দেশ ও অঞ্চল নিয়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের করা ২০১৮ সালের এক সমীক্ষা বলছে, ‘এ ধরনের সহিংসতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ।’

গবেষণায় সবচেয়ে সাম্প্রতিক বছর হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের বন্দুক সহিংসতার পরিসংখ্যান। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বন্দুক সহিংসতায় মৃত্যুহার ছিল দশ দশমিক ছয় শতাংশ। যেখানে কানাডায় এ হার প্রতি এক লাখে দুই দশমিক এক শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় এক দশমিক শুন্য শতাংশ, ফ্রান্সে দুই দশমিক সাত শতাংশ, জার্মানিতে শুন্য দশমিক নয় শতাংশ ও স্পেনে শুন্য দশমিক ছয় শতাংশ।

কিন্তু সহিংসতার এ হার যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি এল সালভাদর, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া ও হন্ডুরাসের মত দেশগুলোতে। সামগ্রিকভাবে, ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে বন্দুক সহিংসতায় মৃত্যুহারে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ২০তম স্থানে।

যুক্তরাষ্ট্রে গণবন্দুক হামলায় বছরে প্রাণহানি কত: ‘গণবন্দুক হামলা’ বা ‘মাস শুটিংয়ের একক কোন সংজ্ঞা নেই। হতাহতের সংখ্যা হামলার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন দিকের ওপর নির্ভর করে এর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হতে পারে। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) মতে, এক বা একাধিক ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে একটি জনবহুল এলাকায় মানুষ হত্যা বা হত্যার চেষ্টায় জড়িত থাকলে তা গণবন্দুক হামলা বা মাস শুটিংয়ের আওতায় পড়বে। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০২০ সালে এ ধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৮ জন (হামলাকারী বাদে)।

যুক্তরাষ্ট্রের গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ (বন্দুক সহিংসতার ঘটনার অনলাইন ডাটাবেস) গণবন্দুক হামলার সংজ্ঞায় বলছে, ‘এটি এমন ঘটনা যেখানে চার বা ততধিক লোককে গুলি করা হয়, এমনকি কেউ নিহত না হলেও (বন্দুকধারী বাদে)। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০২০ সালে বন্দুক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫১৩ জন।

তবে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রে গণবন্দুক হামলায় প্রতি বছর যে প্রাণহানি হয়, দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া সব বন্দুক সহিংসতায় তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

পুলিশের ‘লুকোচুরি’: বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার মতে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণ গেছে দুই শতাধিক মানুষের। একের পর এক বন্দুক হামলায় সাধারণ মানুষ যখন আতঙ্কে, তখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে মার্কিন পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।

মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ।

২০১৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্বরত ​​পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতিটি গুলিবর্ষণের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

এর আগে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউন নামে একজন নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার পর এক তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, দেশটির পুলিশ যত গুলি বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তার অর্ধেকেরও প্রকাশ্যে আসে নি।

পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ও পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে তৈরি ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে প্রাণঘাতী গুলির সংখ্যা ও পরিস্থিতি এবং ভুক্তভোগীদের সামগ্রিক হারে তুলনামূলক কোন পরিবর্তন আসে নি। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন এক হাজার ৪৯ জন।

ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বন্দুক হামলা বা এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারান। পুলিশের গুলিতেও নিহত হন ঠিক একই সংখ্যক মানুষ। যদিও পুলিশের গুলিতে নিহতদের অর্ধেকই শ্বেতাঙ্গ, তবে জনসংখ্যার হার বিবেচনায় কৃষ্ণাঙ্গরাই ভুক্তভোগী হচ্ছেন বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ।

এ ছাড়া পুলিশের হাতে নিহতদের মধ্যে ৯৫ শতাংশেরও বেশি পুরুষ, যাদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

বর্ণবাদ: চলতি বছরের ১৪ মে স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটা। হঠাৎ গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত শহর বাফেলোর একটি সুপার মাকের্ট। আধা-স্বয়ংক্রিয় একটি অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ। সামরিক পোশাকে শরীরে বর্ম পরে চালানো হয় ওই হামলা। নিজের রক্তাক্ত তাণ্ডব অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য একটি ক্যামেরাও ব্যবহার করছিল ওই তরুণ। হামলা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা করতে গিয়ে স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা সে দিন বলেন, ‘এটা ছিল একটি ‘হরর সিনেমার’ সেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মত পরিস্থিতি। কিন্তু সবই ছিল বাস্তব। এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।

বাফেলোর ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হন ১৩ জন। তাদের মধ্যে দশ জনই মারা যান। পরে পুলিশ জানায়, গুলিবিদ্ধ ১৩ জনের মধ্যে ১১ জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। এফবিআইয়ের বর্ণনায় হামলাটি ছিল একটি ‘সহিংস চরমপন্থার’ ঘটনা।

এফবিআইয়ের বাফেলো কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্ট স্টিফেন বেলঙ্গিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘এটি ‘হেইট ক্রাইম’ ও বর্ণবাদে উদ্বুদ্ধ সহিংস চরমপন্থা কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

এ হামলার পরপরই পেইটন এস জেনড্রন নামে সন্দেহভাজন ওই বন্দুকধারীকে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তাকে ‘ফার্স্ট-ডিগ্রি’ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর তদন্তে বেরিয়ে আসে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা গেছে, শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী বিশ্বাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনলাইনে ১৮০ পৃষ্ঠার ‘ইশতেহার’ পোস্ট করেছিলেন ওই তরুণ। ঘৃণাভরা লেখায় অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে শ্বেতাঙ্গদের ‘প্রতিস্থাপনকারী’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিষয়টি।

কৃষ্ণাঙ্গদের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের ‘প্রতিস্থাপন’ করা হচ্ছে, এমন ধারণা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অতি-ডানপন্থি রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে থেকে মূলধারার রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিতেও চলে এসেছে। আর এ মতাদর্শকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করছেন মার্কিন অনেক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, যা নির্বিঘ্নে রিপাবলিকান পার্টির বাগাড়ম্বরে আরো প্রভাবিত হচ্ছে।

অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গরা দুর্বল হয়ে পড়ছে- এমন মতাদর্শকে সামনে তুলে ধরেই নিজের পৈশাচিক আক্রমণকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেন বাফেলোতে হামলা চালানো তরুণ। আর তার ইশতেহার ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সম্পর্কে বর্ণবাদী কথায় ভরা।

২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলা চালিয়ে ৫১ জন মুসল্লিকে হত্যাকাণ্ড থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার দাবি করেন বাফেলোর হামলাকারী। তার এ দাবির মিল পাওয়া যায় ঘটনার সাথেও। হামলার ঘটনা অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ক্যামেরা ব্যবহার করছিলেন ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্ট। হামলার আগে তিনিও প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ইশতেহার। কিন্তু বাফেলোতে হামলাকারী ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ড থেকে যতটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন স্বদেশি অসন্তোষ থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্য অনুসারে, দেশটিতে গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক গোলাগুলি বা বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় নিহতের হার সার্বিকভাবে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।’

তবে বাফেলো হত্যাকাণ্ড শুধু নিহতের সংখ্যার কারণে নয়, হামলার রাজনৈতিক প্রকৃতির কারণেও আলাদা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘এ ঘটনাটিকে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ক্রমবর্ধমান স্বাভাবিকীকরণের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এডুকেশন উইকের তথ্য বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি রাজ্য সম্প্রতি ‘সমালোচনামূলক জাতি তত্ত্ব’ বা বর্ণবাদ ও যৌন শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি আরোপের আইনে সই করেছে ও আরো ১২টি রাজ্য একই ধরনের আইন করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। এ ছাড়া বর্ণবাদী মনোভাবের বিস্তার ঘটতে পারে এমন কিছু বইও তুলে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।’

তবে সম্মিলিত এ প্রচেষ্টাগুলো আমেরিকান বর্ণবাদ ও জেনোফোবিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে উপহাসও তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী ইতিহাসের আলোচনা দেশটির বিদ্যমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও সামাজিক বঞ্চনাসহ নানা বিষয়ের ওপর দৃষ্টি ঘুরিয়েছে।

অনেক সমাজ বিজ্ঞানীর মতে, যুগ যুগ ধরে অবজ্ঞা, অবহেলা আর সুযোগের অভাবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে দেশটির অনেক শ্বেতাঙ্গ নিজেদের ভাবছেন অনিরাপদ। আর সেই অনিরাপত্তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ঘৃণার।

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ‘দেশটিতে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বন্দুক হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।’ এ অবস্থায় ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন সংস্কারের দাবি আইনপ্রণেতাসহ বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলছেন, ‘বন্দুক হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ জন্য দরকার কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ। অন্যকে পরামর্শ বা সবক না দিয়ে মার্কিন প্রশাসনের উচিত আগে নিজ দেশের সংকট নিরসনে নজর দেয়া।’