সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার ২৩ বছর, যে ঘটনায় চমকে গিয়েছিল পুরো পৃথিবী

বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

নিউইয়র্ক সিটি, যুক্তরাষ্ট্র: ২৩ বছর পূর্বের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে চারটি যাত্রীবাহী প্লেন ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্ক সিটির দুইটি আকাশচুম্বী ভবনে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান কয়েক হাজার মানুষ। এ হামলা ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পুরো পৃথিবী চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়।

কী ঘটেছিল সেদিন: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)। ছিনতাইকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে একইসাথে চারটি প্লেন ছিনতাই করে। তারপর সেগুলো ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে আঘাত হানার জন্য বিশাল ও নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে। দুইটি প্লেন বিধ্বস্ত করা হয় নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে। প্রথম প্লেনটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে সকাল আটটা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় প্লেনটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় এর কয়েক মিনিট পরেই, সকাল নয়টা তিন মিনিটে। হামলায় দুইটি ভবনেই আগুন ধরে যায়। ভবন দুইটির ওপরের তলাগুলোতে মানুষজন আটকা পড়ে যায়। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দুইটি ভবনই ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে গুঁড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় প্লেনটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে সকাল নয়টা ৩৭ মিনিটে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর বিশাল এ পেন্টাগন ভবন। এরপর, সকাল দশটা তিন মিনিটে চতুর্থ প্লেনটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ প্লেনের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি বিধ্বস্ত করা হয়। ধারণা করা হয়, ছিনতাইকারীরা চতুর্থ প্লেনটি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে আঘাত হানতে চেয়েছিল।

কত মানুষ মারা গিয়েছিল: এসব হামলায় সব মিলিয়ে মারা যায় দুই হাজার ৯৭৭ জন। এর মধ্যে অবশ্য ১৯ জন ছিনতাইকারী অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নিউইয়র্ক সিটির মানুষ। চারটি প্লেনের ২৪৬ জন যাত্রী প্রত্যেকেই মারা যান। টুইন টাওয়ারের দুইটি ভবনে মারা যান দুই হাজার ৬০৬ জন। তাৎক্ষণিক ও পরে আঘাত থেকে পেন্টাগনের হামলায় প্রাণ হারান ১২৫ জন। সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। পিতা-মাতার সাথে একটি প্লেনের যাত্রী ছিল সে। নিহত সর্বজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি প্লেনে। স্ত্রী জ্যাকুলিনের সাথে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। প্রথম প্লেনটি যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে, তখন ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন লোক ছিল। নর্থ টাওয়ারের যে অংশে প্লেন আঘাত করে, তার উপরের কোন তলার মানুষই প্রাণে বাঁচেনি। তবে, সাউথ টাওয়ারে যেখানে প্লেন আঘাত করে, তার উপরের অংশ থেকে ১৮ জন প্রাণ নিয়ে বের হতে পেরেছিলেন। হতাহতের মধ্যে ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক সিটিতে যারা প্রথম ঘটনাস্থলে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দৌড়ে যান, তাদের মধ্যে মারা যান ৪৪১ জন। হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যারা পরে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার শিকার হন। যেমন দমকলকর্মীদের অনেকে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

কারা ছিল হামলাকারী: উগ্র মতাদর্শের কথিত ইসলামপন্থী সংগঠন আল-কায়েদা আফগানিস্তান থেকে এ হামলার পরিকল্পনা করেছিল। ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন এ গোষ্ঠী মুসলিম বিশ্বে সংঘাত সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোকে। ছিনতাইকারী ছিল মোট ১৯ জন। এদের মধ্যে তিনটি দলে ছিল পাঁচজন করে, যারা প্লেন ছিনতাই করে হামলা চালায় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে। আর যে প্লেনটি পেনসিলভেনিয়ায় ভেঙে পড়ে, তার ছিনতাইকারী দলে ছিল চারজন। প্রত্যেক দলে একজন ছিনতাইকারীর পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ ছিল। এ ছিনতাইকারীরা তাদের পাইলটের ট্রেনিং নেয় যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি ফ্লাইং স্কুলে। ১৫ জন ছিনতাইকারী ছিল সৌদি আরবের নাগরিক। এছাড়া, দুই জন সংযুক্ত আরব আমিরাতের, একজন মিশরের ও একজন লেবাননের নাগরিক।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী ছিল: এ হামলার এক মাসেরও কম সময় পর আল-কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করা ও ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করেন যুক্তরাষ্ট্রেওর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এ অভিযানে যোগ দেয় আন্তর্জাতিক মিত্র জোট। যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পর ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অবশেষে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে ও তাকে খুন করে। নাইন ইলেভেন হামলার অভিযুক্ত পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ২০০৩ সালে গ্রেফতার করা হয় পাকিস্তানে। এরপর থেকে তাকে গুয়ান্তানামো বের বন্দিশিবিরে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে বন্দি রাখা হয়েছে।

আল-কায়েদা এখনো টিকে রয়েছে। আফ্রিকায় সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলোতে গোষ্ঠীটি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। তবে, আফগানিস্তানের ভেতরেও তারা সক্রিয়।

আক্রমণের প্রায় ২০ বছর পর ২০২১ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যায় পশ্চিমা বাহিনী। এরপর দেশটির ক্ষমতা দখল করে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান।

৯/১১র পর যা হয়েছে: ১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলার পর থেকে পুরো পৃথিবীতে আকাশভ্রমণের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিমানবন্দর ও প্লেনের ভেতরের নিরাপত্তা আরো কঠোর করতে ট্রান্সপোর্টেশান সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে পরিবহন নিরাপত্তা প্রশাসন গঠন করা হয়েছে। নিউইয়র্কে হামলার স্থানে ‘গ্রাউন্ড জিরো’র ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে সময় লেগেছিল আট মাসেরও বেশি। সেখানে এখন তৈরি হয়েছে একটি জাদুঘর ও একটি স্মৃতিসৌধ। ভবনগুলো ফের নির্মিত হয়েছে, তবে ভিন্ন নকশায়। সেখানে মধ্যমণি হিসেবে নির্মিত হয়েছে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা ‘ফ্রিডম টাওয়ার’, যার উচ্চতা পূর্বের নর্থ টাওয়ারের চেয়েও বেশি। নর্থ টাওয়ারের উচ্চতা ছিল এক হাজার ৩৬৮ ফুট, আর নয়া ফ্রিডম টাওয়ার এক হাজার ৭৭৬ ফুট উঁচু।