সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

সবার উপর মুক্তিযোদ্ধা

শুক্রবার, আগস্ট ১৮, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী: নেলসন ম্যাণ্ডেলার কাছে পুরো বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মানে মাথানত। ম্যাণ্ডেলা বেঞ্জামিনের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথানত করে। কেন এভাবে মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছেন, প্রশ্ন করা হলে, ম্যাণ্ডেলা বলেছিলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে কীভাবে সম্মান জানাতে হয়, তা দুনিয়াবাসীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমি মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছি।’ দুনিয়াবাসীকে সে শিক্ষা দিলেও বাংলাদেশের কিছু কুলাঙ্গার সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। এই শিক্ষা গ্রহণ করার শক্তি আছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান এত উঁচু স্তরে অবস্থান করে; যা কোন কুলাঙ্গারের পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব নয়।

চণ্ডিদাস বলেছিলেন, ‘শুন হে বন্ধু ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তিনি দেখলে হয়তো বলতেন, ‘শুন হে বন্ধু ভাই/সবার উপরে মুক্তিযোদ্ধা, তাহার উপরে নাই।’

একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেমে একটি জাতীয় পতাকা, একটি সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, সংসদ, মন্ত্রী পরিষদ, রাষ্ট্র ও সরকারের জন্ম। কোন আইনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ আসেনি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আইনের জন্ম। তাই, দেশে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে আইন হয়, অসম্মানে শাস্তির হয় বিধান। কোন মুক্তিযোদ্ধার অসম্মান ব্যক্তিগত অসম্মান নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এটি ভুল নয়, অপরাধ। ভুল ক্ষমার যোগ্য, অপরাধ নয়। এই অপরাধ কেউ ক্ষমা করতে পারে না। এই অপরাধ শাস্তিযোগ্য। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, নোবেল জয়ী হবে, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, অস্কার বিজয়ী, হিমালয় – মহাকাশ জয়ী, ক্রিকেট জয়ী হবে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, সেনাপ্রধান, সচিব হবে। কিন্তু, বীর মুক্তিযোদ্ধা আর কোন দিন হবে না। বাঙালির অনেক বিজয় হবে। কিন্তু, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মহান বিজয়’ এর মত কোন বিজয় হবে না। আর কোন ‘বিজয়’ শব্দের পূর্বে ‘মহান’ শব্দটি লেখা হবে না। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন কী? আমাদের ‘স্বাধীনতা’। এ অর্জন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাই, তারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। যারা তাদের অপমান করে, তারা হাজার বছরের নিকৃষ্ট হায়ওয়ান।

স্বাধীনতার সময় অনেক দেশে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, বাংলাদেশে নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মনের তাগিদে দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ শিখরে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করতে গিয়ে ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মোৎসর্গের লাল রক্ত পতপত করে উড়বে জাতীয় পতাকায় অনন্তকাল।

মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোন কুলাঙ্গারের সার্টিফিকেট দরকার নেই। তাদের মৃত্যুর পর বিউগল বাজবে, জাতীয় পতাকা দিয়ে তাদের মোড়ানো হবে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ সমার্থক শব্দ। যতই চেষ্টা করুক- এই তিনটি শব্দকে কোন কুলাঙ্গার কোন দিন পৃথক করতে পারবে না। তারা অসাধারণ মানুষ। তাদের ভুলে যাওয়া মানে বাংলাদেশকে ভুলে যাওয়া। তাদের অপমান বাংলাদেশের অপমান। মুক্তিযোদ্ধা মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ভালবাসতে হলে একাত্তরকে ভালবাসতে হবে। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভালবাসতে হবে। না হয় কোন দিন বাংলাদেশকে ভালবাসা যাবে না।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, কিছু বাঙালি বিতর্ক জানে না, কুতর্ক জানে। স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিতর্ক নয়, কুতর্ক। কুতর্ক করে কুলাঙ্গার। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জিত স্বাধীন দেশে নিঃশ্বাস আলো গ্রহণ করবে, খেয়ে পরে বাঁচবে আবার তাদের অপমান করবে, তা কখনো হতে দেয়া হবে না। আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিতে পারব না। কিন্তু, মাতৃভাষাকে সম্মান করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ করে জীবন দিতে পারব না। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে পারি। তা দেশপ্রেমিকদের কর্তব্য। এই সাধারণ কাজটি যারা করতে পারবে না, তারা দেশকে ভালবাসতে পারবে না।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবি ‘মুক্তি’। এই কবিতা ও ‘মুক্তি’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় ছিল। তাই, তিনি ৭ মার্চের ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি এক বার আর ‘মুক্তি’ শব্দটি পাঁচ বার উচ্চারণ করেন। কারণ, স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা নয়, মুক্তির জন্য স্বাধীনতা চাই। স্বাধীন তো ১৯৪৭ সালে এক বার হয়েছিলাম। কিন্তু, মুক্তি মেলেনি। এই স্বাধীনতা মুক্তির জন্য। তাই, যারা একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, তারা স্বাধীনতাযোদ্ধা নয়, মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা একাত্তরে অর্জিত। কিন্তু, মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম এখনো চলমান। তাদের ভিশন ছিল। সে ভিশনের পথ ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। ইনশাল্লাহ।

লেখক: গবেষক, চট্টগ্রাম