মো. জসিম উদ্দিন: ২৮ এপ্রিল (রোববার) জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ২৮ এপ্রিলকে দিবসের জন্য বেছে নেয়ার কারণ হল ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এ দিনে কার্যকর হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপিত হয়। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ‘ল ডে’ এবং ‘লিগ্যাল সার্ভিসেস ডে’- দুইটিই উদযাপিত হয়। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস, ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশের ‘আইনগত সহায়তা’র ধ্যান ধারণা কাঠামোগতভাবে নতুন হলেও সাংবিধানিক আইনের ইতিহাসে এটি বেশ পুরনো। রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য মূলনীতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।’ আবার নাগরিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে খ্যাত ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সাংবিধানিক তত্ত্ব অনুযায়ী, ধনী-দরিদ্রকে এক কাতারে আনা হলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। অর্থনীতি ও প্রাচুর্য্য মানুষকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে- যার একটি হল ধনী ও অন্যটি হল দরিদ্র। ধনী ও সচ্ছল মানুষের পক্ষে আইনের আশ্রয়লাভ করা যতটুকু সহজ, দরিদ্র ও নি:স্ব মানুষের পক্ষে ঠিক ততটুকুই কঠিন। সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যারা আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে কিংবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আইনের আশ্রয় লাভের সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদেরকে ন্যায়বিচারে প্রবেশে সক্ষম করার জন্যই আইনগত সহায়তা ব্যবস্থা। গরীব ও নিঃস্ব মানুষ যাতে আর্থিক দৈন্যতার কারণে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে কোনভাবে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য লিগ্যাল এইড ব্যবস্থার সৃষ্টি। শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে একমাত্র আইন আদালতের মাধ্যমেই মানুষ তার নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু, দারিদ্রতা কিংবা অর্থের অভাবে কেউ যদি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের আশ্রয় লাভ করতে না পারে, তবে তার অন্য সব মৌলিক অধিকারগুলোও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
আর্থিক দৈন্যতা বা অসচ্ছলতা একজন মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনভাবেই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না। ১৯৬৮ সনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত মামলায় (জ্যাকসন ভার্সেস বিশপ, এইট সার্কিট কোর্টি অপ আপিল, ইউএসএ) বিচারক হ্যারি ব্ল্যাকমান বলেন, ‘দ্যা কনসেপ্ট অপ সিকিং জাস্টিস ক্যান নট বি অ্যাকুয়াটেড উইদ দ্যা ভ্যালু অব ডলারস। মানি প্লেজ নো রুল ইন সিকিং জাস্টিস। ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি পি.এন ভগবতির মতে, ‘তিনটি জিনিসের অভাব দেখা দিলে গরীবরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এগুলো হল সচেতনতা; অধিকার দাবী করা ও সম্পদের অপ্রতুলতা।
আইনগত সহায়তাকে এত দিন রাষ্ট্রের দান বা বদান্যতা মনে করা হলেও আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে এ ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গরিব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টীকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনি সহায়তা দান করা এখন আর রাষ্ট্রের করুণা বা বদান্যতা নয়। বরং এটি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য দায়িত্ব। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আইনগত শিক্ষার প্রসার, আইনগত তথ্য সহজলভ্যকরণ, আইনগত ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচারে সহজ অভিগম্যতা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদিকে আইনগত সহায়তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম এগিয়েছে অনেকখানি। কিন্তু, এখনো যেতে হবে বহু দূর। বাংলাদেশে দরিদ্র বান্ধব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। হাতেগোনা যে দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, তার মধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা অন্যতম। ইদানিংকালে সংস্থার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে ঘিরে দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের মাঝে যে আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে, তা যেন কোনভাবেই ভেঙ্গে না পড়ে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর ও মানসম্মত আইনি সেবা নিশ্চিত করা সংস্থার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে মামলা বা বিরোধের নিস্পত্তিকেও সংস্থার কার্য-পরিধির মধ্যে আনা হয়েছে। মামলাজট ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এ দুইটি এখন দেশের বিচার বিভাগের অন্যতম প্রধান সমস্যা। এমনকি দাদার আমলে দায়ের করা মামলা বহু ক্ষেত্রে নাতির জীবদ্দশায়ও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এভাবে বিরোধভূক্ত পরিবারগুলো বংশানুক্রমে মামলা বা বিরোধ বহন করে চলেছে যা সমাজের জন্য খুবই নেতিবাচক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে সৃষ্ট সব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কেবল আদালতের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। ছোটখাটো ও আপোষযোগ্য বিরোধগুলো আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের জন্য লিগ্যাল এইড অফিস একটি আদর্শ স্থান হতে পারে। লিগ্যাল এইড অফিস আদালতের ছায়া হিসেবে কাজ করতে পারে। আইন আদালতের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে লিগ্যাল এইড অফিসের মধ্যস্থতায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধীয় পক্ষগণ নিজেরাই বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারেন। এতে পক্ষগণের অর্থ ও সময় -দুইটিরই সাশ্রয় হয়। আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত সমাধানে কোন পক্ষই হারে না, বরং উভয় পক্ষই জিতে। এ কারণে কার্যকর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির স্বার্থে লিগ্যাল এইড অফিসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনগত সহায়তা করা রাষ্ট্রের কোন দান বা বদান্যতা নয়। বরং, এটি অস্বচ্ছল ও দরিদ্র মানুষের অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিকের এ অধিকার রক্ষা করতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও দেশের মানুষকে এ অধিকার ফিরে পেতে বহু বছর, যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের গৃহীত নানামুখী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। স্বল্পতম সময়ে সরকারি আইন সহায়তা কর্মসূচির যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বে-সরকারি সংস্থা, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে নব উদ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি আইনি সেবার এ বার্তা অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
লেখক: অতিরিক্ত জেলা জজ, বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘আইন কর্মকর্তা’ পদে প্রেষণে কর্মরত।