ঢাকা: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর কোন নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি দলটি। গেল ১২ বছর ধরে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি করেছেন। এমন কথাও বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু, সেই জামায়াত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আচমকা প্রাকাশ্যে সরব হয়েছে। দলটির হঠাৎ রাজপথে সরব হওয়া কিংবা প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে প্রশাসনের অনুমতি দেয়ার নেপথ্যে কী? এ নিয়ে রাজনৈতিক সাঠে চলছে নানা গুঞ্জন, আলোচনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘যেহেতু জামায়াত নিবন্ধন হারানো দল, আর বাংলাদেশের সংবিধানে নিবন্ধন না থাকলেও সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে, তাদের সমাবেশের অনুমতি দিয়ে সরকার দেশ-বিদেশে একটি বার্তা দিতে চাইছে, সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। এতে যারা বলছে, দেশে গণতন্ত্র নেই, তাদের একটি শক্ত উত্তরও দেয়া গেল- সরকার সভা-সমাবেশ উন্মুক্ত রেখেছে। এখানে সরকারের কোন হস্তক্ষেপ নেই।’
দ্বিতীয়ত, চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতকে প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে দেয়া সরকারের একটি কৌশলের অংশও হতে পারে। বোদ্ধামহলে গুঞ্জন আছে, নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন মহলের সাথে জামায়াতের একটা সমঝোতা হয়েছে- বিএনপি নির্বাচনে না গেলে জামায়াতকে নির্বাচনে এনে সেই জায়গা পূরণ করা যায়।
যেমন- একাধিক নামে নিবন্ধন পাওয়া জামায়াতের বিভিন্ন সংগঠনগুলো ভোটের মাঠে লড়তে পারবে। তখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানো সম্ভব হবে। বিষয়টি নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে জাতীয় পার্টিরর চেয়ারম্যান জিএম কাদের এক সমাবেশে বলেছেন, রাজনীতির মাঠে কথা আছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিভিন্ন নামে কিছু সিট দেবে। আমাদেরও কিছু সিট দেবে। তাহলে, নির্বাচনের দরকার কী? এ অবস্থায় এটি রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে চাপে রাখতে সরকারের একটি ভিন্ন কৌশলও হতে পারে।
তৃতীয়ত, জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে পাশের দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশই নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে থাকে দলটিকে। এছাড়া, জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে যেখানে সরকার গেল ১২ বছর ধরে প্রকাশ্যে বলে আসছে, সেখানে তাদের প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে ভারতসহ বন্ধুদেশগুলোকে এটাও বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে- বিএনপির সাথে উপরে জামায়াতের সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ভেতরে ভেতরে একই পথে চলছে চিরবন্ধু দল দুইটি। কারণ, জামায়াতের দাবি আর বিএনপির দাবির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
প্রায় অভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে তারা। আর জামায়াতকে মাঠে নামতে আসকারা দিচ্ছে খোদ বিএনপি। ফলে, আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিষয়টি অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে পারে। এ বিষয়টিও সরকারের ভাবনায় থাকতে পারে।
এ দিকে, জামায়াতকে সরকার এমন এক সময়ে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে, যখন রাজনীতি বেশ ঘটনাবহুল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন যাতে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয় সে লক্ষ্যে মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই ভিসানীতির ভাষ্য মতে, যে সব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বানচালের আওতায় পড়বে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা। এ বিষয়টি জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়ার পেছনে কাজ করেছে কিনা- এটি নিয়েও এক ধরনের আলোচনা আছে। কারো কারো মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি জামায়াতে ইসলামীর জন্য নতুন ‘অপরচুনিটি’ বা সুযোগ তৈরি করেছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, ‘গেল দশ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে আমরা একটি অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি আমাদের কিছুটা হলেও উৎসাহিত করেছে।’
তবে, তিনি সাথে এটা যোগ করেন, ‘কার কোন সিদ্ধান্ত দ্বারা জামায়াতে ইসলামী এনকারেজড (উৎসাহিত) হয় না। আমরা আইন অনুগত একটি রাজনৈতিক দল। আমরা সংঘাত-সংঘর্ষের পরিস্থিতি চাই না।’
তবে, এ নিয়ে সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির বি টিম হিসেবে মাঠে রয়েছে জামায়াত। এক্ষেত্রে, জামায়াতকে আলাদা করা হলে এক দিকে বিএনপির শক্তি কমে যাবে, অন্য দিকে, একাধিক নামে নিবন্ধন পাওয়া জামায়াতের বিভিন্ন সংগঠনগুলো ভোটের মাঠে লড়তে পারবে। তখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানো সম্ভব হবে। এছাড়া, জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে আদালতের বিষয়টি এখনো ফয়সালা হয়নি। পরিস্থিতি তেমন হলে জামায়াতের বিষয়টি ফয়সালাও হতে পারে।
দশ বছর পর কেন প্রকাশ্যে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও জামায়াতের সাথে কখনোই ক্ষমতাসীনদের সখ্য হবে না- এ বিষয়ে স্পষ্ট জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী এ সংগঠনকে রাজনৈতিকভাবে মূলোৎপাটন করা প্রয়োজন। কেন তাদের অনুমতি দেয়া হল- এ ব্যাপারটি আমার জানা নেই। তাই, মন্তব্য করতে পারছি না। তবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এ সংগঠনের বিচার দাবি করি সব সময়।’
গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিধান থাকায় উচ্চ আদালত কর্তৃক নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর প্রকাশ্যে শনিবার (১০ জুন) ঢাকায় সমাবেশ করেছে। ডিএমপির অনুমতি সাপেক্ষে রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সমাবেশ করে সংগঠনটি। যদিও যুদ্ধাপরাধসহ নানা কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত প্রায় এক যুগ প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ পায়নি। একই সময়ে ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলোও বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রকাশ্যে তেমন কোন কর্মসূচিও ছিল না। যদিও বিভিন্ন সময় তারা ঝটিকা মিটিং-মিছিল করেছে। এমনকি ঘরোয়াভাবেও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা মিটিং করতে গেলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছে।
এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার শেষে দলটির সিনিয়র কয়েকজন নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। ওই সময় আন্দোলনের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসন্ত্রাসসহ নানা কারণে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিকভাবে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনও বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।