আবছার উদ্দিন অলি: গানের মানুষ, প্রাণের মানুষ সনজিত আচার্য্য। তার গান আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আঞ্চলিক গানের প্রতি ভালবাসার জন্য বহু সুযোগ পেয়েও চট্টগ্রাম ছেড়ে যাননি। গান পাগল মানুষটি সারা জীবন চট্টগ্রাম নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন লোভ লালশার উর্ধ্বে থেকে। হাসি মুখে কথা বলতেন সব সময়; বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা ছিল তার বড় গুণ।
সনজিত আচার্য্য একাধারে গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি ৫০০ গান লিখেছেন। তার বহু গান তুমুল জনপ্রিয়। সনজিত আচার্য্য চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার চাপড়া গ্রামের কীর্তনীয়া মনোরঞ্জন আচার্যের ছেলে। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ২৫ জুন।
বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও মঞ্চের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সনজিত আচার্য্য ছোট বেলা থেকেই গানকে ভালবেসে সাধনা করে গেছেন নিবেদিত প্রাণ হিসেবে। নতুন নতুন গান সৃষ্টিতে তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠার তুলনা ছিল না। গুনগুনীয়ে গান গাওয়া ছিল তার সহজাত অভ্যাস। যেখানে আঞ্চলিক গানের আসর, সেখানেই সনজিত আচার্য্যের উপস্থিতি সবার আগে। গানের জন্য বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক সংগঠন থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। সব সময় আঞ্চলিক গান নিয়ে গর্ববোধ করতেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান দিয়ে চট্টগ্রামকে সম্মানিত করতেন। ১৯৮৫ সালে সোনাই বন্ধু ছবিতে তার কথা ও সুরে এন্ড্রু কিশোর ও শাম্মী আক্তারের গাওয়া গান ‘মনকে বুঝায় কেন করে’ এখনো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের মৃত্যুর পর আঞ্চলিক গানের রাজা-রাণী হিসেবে উপাধি পেয়েছেন সনজিত আচার্য্য-কল্যাণী ঘোষ। এই জুটির গাওয়া আঞ্চলিক গান বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তিনি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম সিটির পাথরঘাটার ইকবাল রোডে নিজের বাসায় থাকতেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের কালজয়ী জুটির পর সনজিত আচার্য্য-কল্যাণী ঘোষ জুটিই হল সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। সনজিত আচার্য্য-শেফালী ঘোষ, সনজিত আচার্য্য-কল্যাণী ঘোষ ও সনজিত আচার্য্য-কান্তা নন্দীর দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া গানগুলো চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে আজও ফেরে।
সনজিত আচার্য্যে সাথে আমার সর্বশেষ গেল ৫ ডিসেম্বর প্রয়াত গীতিকার ইউনুস আলকরনীর মেজবানে দেখা হয়। দেখা হওয়া মাত্রই প্রথমে বলেন অভিনেতা এসএ রহিম মেজবানে আসবেন কিনা? এরপরে অভিমানের সুরে বলেন, কি দোষ করেছি জানি না, আজ পাঁছ মাস ধরে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে অনুষ্ঠান পাচ্ছি না। টিভি থেকে রেকডিং সিডিউল দিয়েও তা আবার বাতিল করাতে খুবই অপমান লেগেছে। এত বছর সঙ্গীত সাধনা করে এই অপমানটুকু টিভি কতৃর্পক্ষ না করলেও পারতেন।
দ্বৈতকণ্ঠে পাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘বাজান গিয়ে দইনর বিলত/পাটি বিছাই দিয়্যি বইও ঘরত…., বাঁশ ডুয়ার আড়ালত থাই/আঁরে ডাকর কিয়রল্লাই…., গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়। এছাড়া, বাঁশখালী মইশখালী/পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই টানে/তোরা হন হন যাবি আঁর সাম্পানে, ওরে কর্ণফুলী রে, স্বাক্ষী রাখিলাম তোরে…., গুরা গুরা হতা হই/বাগানের আড়ালত বই/পিরিতির দেবাইল্যা আঁরারে বানাইলা’ ও সত্যি গরি কঅনা কক্সবাজার লাই যাইবা’।
এছাড়া ‘বাঁশখালী মইশখালী/পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই টানে/তোরা হন হন যাবি আঁর সাম্পানে,’ ওরে কর্ণফুলী রে…., স্বাক্ষী রাখিলাম তোরে’সহ বহু গান এখনো মানুষের মানুষের মুখে ফেরে।
গেল সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাতটা দশ মিনিটে সিটির বেসরকারি একটি হাসপাতালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি তিন মেয়ে ও স্ত্রী স্বপ্না আচার্য্যসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এই গুণী শিল্পীর মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকে ছুটে যান হাসপাতাল এবং এ সঙ্গীতজ্ঞের পাথরঘাটার বাসায়। আঞ্চলিক গানের রাজা সনজিত আচার্য্যের মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার, চট্টগ্রাম।