টোকিও, জাপান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও একমত হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ স্থায়ী বাস্তুচ্যূতি আশ্রয়দাতা কমিউনিটির ওপর চাপ বাড়াবে এবং এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উভয় নেতা এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এ সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যূত মানুষের জন্য একটি ‘টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।’
শেখ হাসিনা এ বাস্তুচ্যূত জনসংখ্যার দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য এ বাস্তুচ্যূতির মূল কারণগুলোর সমাধান করে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে মায়ানমার কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি ভাসানচওে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে প্রথম দেশ হিসেবে জাপানের মানবিক সহায়তাসহ এ বাস্তুচ্যূত শরণার্থীদের জন্য জাপানের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
কিশিদা তাদের প্রতি জাপানের ক্রমাগত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে ভাসানচরসহ বাস্তুচ্যূত জনগোষ্ঠী ও বাস্তুচ্যূত ব্যক্তিদের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
তিনি আরো বলেন, ‘২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে আনুমানিক দুই দশমিক তিন বিলিয়ন ইয়েনের উপরে সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া, পূর্ববর্তী সহায়তার পরিমাণ প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।’
দুই প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাবাসনের পর তাদের স্বনির্ভর জীবনের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণের মতো উপযুক্ত সহায়তা প্রদানের গুরুত্বের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।
কিশিদা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যূত ও স্কুলে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য জাপানে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী মায়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান। তারা মায়ানমারের সংকট সমাধানের জন্য আসিয়ানের প্রচেষ্টার প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে তারা আসিয়ান চেয়ারের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐক্যমত বাস্তবায়নের জন্য মায়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তারা এ বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো মায়ানমারের পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত নানাবিধ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। তারা মায়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
কিশিদা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের অব্যাহত মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের ভূয়োসী প্রশংসা করেন।
কিশিদা ফুমিওর আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা বর্তমানে জাপানে সরকারি সফরে রয়েছেন ও বুধবার (২৬ এপ্রিল) একটি শীর্ষ বৈঠক করেছেন।
যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসনের ভিত্তিতে বহুপাক্ষিকতার প্রতি তাদের সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রাথমিক সংস্কারসহ জাতিসংঘকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করার জন্য তাদের দৃঢ়সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী কিশিদা জাপানের স্থায়ী সদস্য হওয়াসহ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারে ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। কিশিদা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্যদের সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি ২০২২ সালের জন্য জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তার সক্ষমতার প্রশংসা করেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ‘পিস বিল্ডিং সেন্টার’ এর সাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
দুই প্রধানমন্ত্রী শান্তি সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছেন। উভয় নেতাই পারমাণবিক অস্ত্রহীন বিশ্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
তারা পূনর্নিশ্চিত করেছেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের অপ্রসারণ চুক্তি (এনপিটি) হল আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও পাঁচটি অপ্রসারণ ব্যবস্থার ভিত্তি এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি।
তারা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রাগারের ৪০ বছরের দীর্ঘ পতন অবশ্যই টিকিয়ে রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা ‘হিরোশিমা অ্যাকশন প্ল্যানের’ সাথে সঙ্গতি রেখে কিশিদার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্ল্যানারি অধিবেশনে গৃহীত ‘স্টেপস টু বিল্ডিং এ কমন রোডম্যাপ টুয়ার্ডস এ ওয়ার্ল্ড ইউদআউট নিউক্লিয়ার ইউপনস্’ শীর্ষক প্রস্তাব উত্থাপনে জাপানের উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
কিশিদা বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য তার কৃতজ্ঞতা জানান।
এ সময় দুই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ও তাদের অর্থায়ন ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়াও, তারা সন্ত্রাসীদের আন্তঃসীমান্ত চলাচল বন্ধের ওপরও জোর দেন।
হাসিনা পুনরুল্লেখ করেন যে, তার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন, সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করছে। তার সরকার সাধারণ মানুষের কার্যকরী অংশগ্রহণের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্কগুলো থামাতে সক্ষম হয়েছে।
কিশিদা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বাস্তবায়িত প্রকল্প ও জাপানি ব্যবসায় কর্মরত জাপানিসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সব জাপানি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখার অনুরোধ জানান। এছাড়াও, তিনি সহিংসা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলারও আহ্বান জানান।
তারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় তাদের পারস্পারিক সহযোগিতা বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।