রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

আবুল কালাম তালুকদারের গ্রন্থ প্রসঙ্গে কিছু কথা…

শনিবার, জুন ২৪, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

সুকান্ত ভট্টাচার্য্য: ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’
এক মাহেন্দ্রক্ষণে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হল চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সম্প্রতি (গেল ২৮ জানুয়ারি)। এতে প্রধান অতিথি ছিলাম আমি। চমকপ্রদ বিষয় যে, সে অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আমার প্রাক্তন ছাত্রী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (তৎকালীন চন্দনাইশ, বর্তমানে সিলেট সদর উপজেলা) নাছরীন আক্তার। সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনায় গ্রন্থ দুটির কথামুখ বা মুখবন্ধ লিখেছে নাছরীন নিজেই, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ অতিথি লেখক ও শিক্ষক প্রশিক্ষক শামসুদ্দীন শিশিরসহ অনেকে ছিলেন। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর।

প্রথমে আমি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোকপাত করছি। গ্রন্থটি পড়ে আমি অমিয় তৃপ্তি লাভ করি। গ্রন্থে নিবন্ধিত প্রতিটি কবিতা যেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। জীবনের আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা সুখ-দুঃখের গল্পগুলো কবির নিপুণ গাঁথুনিতে বাস্তবতায় প্রতিভাত হয়ে ধরা দিয়েছে। কবিতায় সাবলীল ছন্দের দোলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কেবল অলংকার সমৃদ্ধ ভাষার সাথে ছন্দ মিলিয়ে দিলে কবিতা হয় না, তার সাথে যা প্রয়োজন তা হল, ভাব ও ভাবনার মেলবন্ধন; দর্শনের সুনিপুণ বুনন। তার লেখায় এ মিশ্রণের স্নিগ্ধতা আমি পেয়েছি। তাই, তিনি কবি; তার লেখাগুলো কবিতা। পল্লিকবি জসীম উদদীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় পল্লি সৌন্দর্যের যে আত্মপ্রকাশ ঘটছে- এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘এসো আমার গাঁয়ে’ কবিতায় যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি অবলীলায়। তার ‘ছেঁড়াচিঠি’ কবিতার বিভিন্ন ভাগে সাধারণ নর-নারী ও তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের যে অপমৃত্যু ঘটেছে, মানুষ নামক হায়েনাদের বিষাক্ত ছোবলে তার বিরুদ্ধে কবি অত্যন্ত সাহসিকতায় কলম বিদ্রোহ করেছেন। তার অনবদ্য প্রেমের কবিতাগুলো আমার কাছে অনিন্দ্যরূপে ধরা দিয়েছে। মিলনের সুখ-স্মৃতি ও বিরহের বেদনাগুলো অত্যুজ্জ্বল উপমায় অলংকৃত হয়েছে। তার বিরহ মিলনের কবিতালো পড়ে আমি অশ্রুসিক্ত হই। অনেকের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মেলবন্ধন যেন আমি বাস্তবে খুঁজে পেয়েছি তার কবিতায়। সত্যিকার অর্থে এখানেই কবির সার্থকতা। ‘স্বপ্নসেতু’: মোরা গর্বিত জাতি’- কবিতাগুলো গ্রন্থটিকে মহিমান্বিত করেছে ও দেশের প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটেছে। ‘হলুদ পাখিটিরে দেখিনা আর’-কবিতাটি কবির এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে দর্পণের মত ভেসে উঠেছে বর্তমান সমাজের সমসাময়িক অনেক বেদনাবহ চিত্র। এ কবিতায় রূপক শব্দের ব্যবহারীলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।

পরিশেষে, বলতে হয় সহজ-সরল ও সাবলীল উপস্থাপনায় জীবন-দর্শনের সুনিপুণ বুননে ও উপমা অলংকারের নান্দনিক ভূষণে গ্রন্থটি কবির অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর বহন করে।

তার কাব্যউপন্যাস-‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি’ গদ্যপদ্যের মিশ্রণে বাংলা সাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এক সৎ সাহসী যুবক সেলিমের সত্যবাক্য প্রকাশ ও ধর্ষিতা তরুণী শায়লার সুবিচার প্রাপ্তি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে রচিত এ উপন্যাসটি পড়ে আমি বিমুগ্ধ। এ উপন্যাসে নজরুল-রবীন্দ্র ভাবধারার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। কবিগুরুর শেষের কবিতায় ব্যারিস্টার অমিত রায় ও শ্রীমতি লাবণ্যলতার প্রেম-বিরহের সংলাপ ও হৃদয়ছোঁয়া কথোপকথন যেভাবে কবিতাশ্রিত হয়েছে। এখানেও সেলিম-শায়লার বাক্য বিনিময় ছন্দাশ্রিত হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ শেষ হয়েছে বিরহে আর ‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি’-র যবনিকা নেমে এসেছে ধর্ষিতা নারীর প্রতি হৃদয়ের উদার ভালবাসায় মিলনের সুর মূর্ছনায়। উপন্যাসটি সামাজিক কুপ্রথা, অবিচার, অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংস্কারে বিজয়কেতন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গ্রন্থটি বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমার সুদৃঢ় প্রতীতি। অনুপম সুকুমার বৃত্তি আর মানবতার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় ঋদ্ধ কবি আর তারই হৃদয়ের নির্যাস কবিতার আলোকছটায় উদ্ভাসিত হোক- এ তমাসাঢাকা যুদ্ধ-যন্ত্রণায় কাতর বসুধা। জয় হোক কবি ও কবিতার। কবিতা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে জীবনের পরতে পরতে–
‘জিহবায় উচ্চরিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
সমগ্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকন্ঠ সংগীত কবিতা।
জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।’

লেখক: বিসিএস (শিক্ষা) ও বিসিএস (প্রশাসন), প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ ও সিনেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।