ঢাকা: একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দিয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা সাংসদ গোলাম মোহাম্মদ কাদেরবলেছেন, ‘প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। রক্ত দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষা দেয় একুশে। সুশাসন ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অনুপ্রেরণা যোগায় একুশে ফেব্রুয়ারি। অন্যায়কে পরাজিত করতেই আমরা রাজনীতি করব। ১৯৫২ সালে অন্যায়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে আমাদের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সাফল্যই প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ভাষা আন্দেলনের অনুপ্রেরণায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছে। ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় আমরা একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। অন্যায়ের প্রতিবাদে রক্ত দেয়ার শিক্ষাও আমাদের দিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল মুক্তির জন্য। আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু মুক্তি পাইনি। দেশের মানুষ বৈষম্য ও কুশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তি পায় না।’
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীস্থ কার্যালয় মিলনায়তনে জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টি আয়োজিত আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভা শেষে একুশের চেতনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সদস্যরা।
জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সাংসদ শেরিফা কাদেরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমেদের পরিচালনায় আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে লেখা আছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা দীর্ঘ সময়ে বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সর্বস্তরে বাংলাকে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ সংসদে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে প্রচলিত করতে আইন পাশ করেন।’
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘আমাদের দেশের নেতারা জনগণের প্রত্যাশার কথা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যান। ক্ষমতায় যাওয়ার পর আর জনগণের দিকে তাকায় না। জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে, নেতারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে এক কথা বলেন আবার ক্ষমমতায় গিয়ে আরেক কথা বলেন। দেশের মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। যারা পল্লীবন্ধুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পরবর্তী রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়েছেন, তারা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র ও সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’
দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘গণতন্ত্রের কথা বলে এক সরকার থেকে অন্য সরকার আসছে। কিন্তু, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে কারো উদ্যোগ নেই। প্রজাতন্ত্র মানেই প্রজাদের তন্ত্র। প্রজারা নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন, প্রতিনিধিরা প্রজাদের ইচ্ছেমত দেশ চালাবেন। তাই, সাধারণ মানুষকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অধিকার নয়, এটা সাধারণ মানুষের দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের ইচ্ছে মত দেশ চালাতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ফের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি পরিবর্তন করবেন দেশের মানুষ। এটাই গণতন্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘দেশে কী গণতন্ত্র আছে? সাধারণ মানুষ কী প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন? প্রতিনিধিরা কী জনগণের কথা শুনতে চায় ? এখন কথা বলতে চাইলে সাধারণ মানুষের কন্ঠরোধ করার ব্যবস্থা হয়। সরকারের সমালোচনা করলে বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতা এক কথা নয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে রাষ্ট্রের কর্মচারিরা সরকাকে সহায়তা করবে। তারা কিন্তু সরকারের লোক নয়, তারা সরকারকে সাহায্য করবে। কিন্তু নেতারাও দেশ ও জাতির কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে আসেন। এখন যে সরকার আসে সেই সরকারের দলীয় লোকজন সব কিছুতে প্রাধান্য পায়। রাষ্ট্রের সব সুবিধা দলীয় লোকজন পাচ্ছে। রাষ্ট্র এখন সরকারদলীয় হয়ে গেছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিরা দলীয় নেতা-কর্মীদের মত আচরণ করছে।’
গোলাম মোহাম্মদ কাদের আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনা এখন কোথায়? যার জন্য দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি কেয়ারটেকার সরকার না দিয়ে একটি নির্বাচন করল। তখন আমরা আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে কেয়ারটেকার সরকারের জন্য আন্দোলন করেছি। বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্বাচন করল। আমরা সবাই মিলে চিরদিনের জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকারের মত একটি সরকারের কথা বলেছি। তখন কেয়ারটেকারের আন্ডারে আরেকটি নির্বাচন হলো। তখন বিএনপি কেয়ারটেকারের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। নবম সংসদে আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার বাতিল করে দিল, এখন বিএনপি কেয়ারটেকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি প্রথম হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ বলেছে, এ জরিপের কোন ভিত্তি নেই। আবার বিএনপি পরপর চার বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তখন বিএনপি বলেছে, এ জরিপের ভিত্তি নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড়বড় কথা বলেন। কিন্তু, ক্ষমতায় গিয়ে তারা নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।’
গোলাম মোহাম্মদ কাদের এ সময় বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উন্নয়নে একটি বিল্ডিং হয়েছে, তারা কি কাজ করছে, তা আমরা জানতে পারছি না। এ সরকারের কৃতিত্ব শুধু বিল্ডিং আর কমিশন। জনগণের কথা বলার অধিকার নেই। গণ মাধ্যম বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। একতরফাভাবে খবর দেয়া হচ্ছে। দেশে ডলার সংকট চলছে। কাঁচামালের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ সংসার চালাতে পারছে না। একটি শ্রেণি দেশের ৯০ ভাগ সম্পদ লুটপাট করছে। আর মাত্র দশ ভাগ সম্পদের ভোগ করছেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ। দেশের মানুষ অর্থের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এমন বাস্তবতায় যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে না খেয়ে মরতে হবে। প্রতিদিনই নিত্য পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। আমরা রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে বলেছি। সপ্তাহে এক দিন নিত্য পণ্য রেশনিংয়ের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে বিতবরণ করে দেশের মানুষ বাঁচাতে হবে। নদী, ফুটপাত ও রাস্তায় ইজারার নামে চাঁদাবাজী চলছে। এখন ভিক্ষুকের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে একটি গোষ্ঠি। লুটপাটের টাকা বিদেশে পাচার করছে। সরকার এ সংবাদ গোপন করছে।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব সাংসদ মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই আইন করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যবস্থা করেছিল। একুশের চেতনায় আমরা সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকব। গণ মানুষের জন্য আমরা সংসদে ও রাজপথে কথা বলব। কোন অন্যায়ের কাছে আমরা মাথা নত করব না।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, ‘একুশের চেতনায় আমরা পল্লীবন্ধুর স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব। জাতীয় পার্টি গণ মানুষের দল, গণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জাতীয় পার্টির রাজনীতি। দেশের মানুষ জাতীয় পাটিকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়।’
আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাংসদ ফখরুল ইমাম, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মোস্তফা আল মাহমুদ, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হেনা খান পন্নি, নাজনিন সুলতানা, ভাইস চেয়ারম্যান সাংসদ আহসান আদেলুর রহমান আদেল, সালমা হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু।
উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন, মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, মাসরুর মাওলা, ভাইস চেয়ারম্যান নিগার সুলতানা রানী, নুরুন্নাহার বেগম, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন মঞ্জু, সাংগঠনিক সম্পাদক নির্মল চন্দ্র দাস, মো. হেলাল উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন তোতা, মাহমুদা রহমান মুন্নি, কাজী আবুল খায়ের, মাখন সরকার, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য মাসুদুর রহমান মাছুম, এমএ রাজ্জাক খান, মো. জহিরুল ইসলাম মিন্টু, আহাদ ইউ চৌধুরী শাহীন, গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম সম্পাদকমন্ডলী মো. হেলাল উদ্দিন হেলাল, আজহারুল ইসলাম সরকার, জাকির হোসেন মৃধা, মাহমুদ আলম, সমরেশ মন্ডল মানিক, সেলিমা খান, মীর সামছুল আলম লিপটন, কেন্দ্রীয় ফরিদা ইয়াসমিন, আব্দুস সাত্তার, মিনি খান, মোনাজাত চৌধুরী, ইলোরা ইয়াসমিন, মোতাহার হোসেন শাহীন, শামীম আহমেদ রিজভী, আলমগীর হোসেন, শাহিনারা সুলতানা রীমা, এলাহান উদ্দিন, মো. আসাদুল হক, নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মোহাম্মদ আলী, জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির নেতা মোস্তফা জামান বাবু, জিয়াউর রহমান, রাজু চৌধুরী, মিরাজ মেহেদী, চম্পা মন্ডল, সিরাজুম মনিরা, তামান্না চৌধুরী, লায়লাতুল কদর, লীন, বেলায়েত হোসেন সাজু, সালাউদ্দিন ববি, ওমর ফারুক সুজন, জাতীয় ছাত্র সমাজের সভাপতি আল মামুন, সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফ খান, মোটর শ্রমিক পার্টির সভাপতি মেহেদী হাসান শিপন, হকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মিজান, মহানগর নেতা, রিয়াজ আহমেদ, আলাল আহমেদ ও খলিলুর রহমান খলিল।