মো. গনি মিয়া বাবুল: আমার বাবা মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি শুধু আমার জন্মদাতা নন, আমার আদর্শেরও প্রতীক। তিনি আমার শক্তি ও প্রেরণা। ২০২৩ এর শনিবার ১২ আগস্ট তার নবম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ইসমাইল হোসেন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তার জন্ম স্থান গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল সকাল আটটায় শ্রীপুর টেপিরবাড়ী গ্রামস্থ মরহুমের কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল, সকাল দশটা থেকে কোরআনখানি, বাদ জুম্মা মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে দুপুরে খাবারের আয়োজন। বিকাল চারটায় টেপিরবাড়ীস্থ কাছম আলী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল প্রাঙ্গণে মরহুমের স্মরণে আলোচনা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
উল্লেখ্য, মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকেও একই কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। তার রুহের মাগফিরাত কামনার জন্যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে দোয়া চেয়েছেন তার পরিবার।
২০১৪ এর ১২ আগস্ট আমার বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে আমার দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত কাছম আলী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল মাঠে ওই দিন বিকালে তার নামাজে জানাযা শেষে টেপিরবাড়ি গ্রামে পারিবারিক কবর স্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। তখন আকাশ থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামছিল। মনে হয়, বাবার শোকে বুঝি আকাশও কাঁদছিল। জানাযায় শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল, শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম প্রধান, সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বুলবুল, শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র মো. আনিছুর রহমান, বিএনপির শ্রীপুর উপজেলা শাখার সহ সভাপতি মো. মোসলেহ উদ্দিন, ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আশ্রাফ আলী বেপারী, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মন্ডল, শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম, শ্রীপুর উপজেলা শাখা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলামসহ প্রায় পাঁচ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লী উপস্থিত ছিলেন। ২০১৪ এর ১৬ আগস্ট কাছম আলী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল মাঠে তার কুলখানি অনুষ্ঠানেও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
আমার বাবা ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ, নিরংহকার ও পরোপকারী। জীবনভর দিয়েছেন সব সময় উজাড় করে, নেননি কিছুই। হৃদয় দিয়েই ভালবাসতেন সুহৃদসহ ছোট-বড় সকলকেই। যে ভালবাসা ছিল নিখাদ, নির্ভেজাল, তার মধ্যে কোন দিন রাগ, ক্ষোভ, জেদ, বিরক্তি, অসহিষ্ণুতা, মুখভার- এগুলোর একটিও ছিল না। তার কথায় কেউ আহত হয়েছেন, এমন নজির মেলা ভার। যে কোন কাজে তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে পাননি- এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাবা হলেন আমার আদর্শ মানুষ। আমার কাছে আমার বাবা ভাল বুজুর্গ মানুষ বা তিনি ভাল পীর ছিলেন। তিনি আমার শক্তিরও উৎস।
আমি আমার বাবাকে কাছ থেকে দেখেছি, নিকট থেকে জেনেছি। বাবার মুখে কখনো খারাপ কথা শুনিনি, বাবা কখনো কাউকে গালি দিতেন না। সিগারেট খেতেন না, দোকানে গিয়ে কখনো আড্ডা দিতেন না। বাবার কোন খারাপ বন্ধু ছিল না। বাবা কখনো খারাপ মানুষের সাথে ওঠাবসা করেননি। বাবা কারো সাথে কোন দিন খারাপ ব্যবহার করতেন না। আমার দৃষ্টিতে আমার বাবা হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। তিনি ছিলেন ভাল অভিভাবক। আমার বাবা তার ভাইদের মধ্যে ছিলেন সবার বড়। তারা বাবাকে সম্মান করতেন, চাচারা আমার বাবাকে দাদা বলে সম্বোধন করতেন।
আমার বাবা মেট্টিক পাশ করার পর কিছু দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তারপর তিনি সফলতা ও প্রশংসার সাথে ব্যবসায় করেছেন। জীবনের শেষ অংশে তিনি নিজস্ব জোত-জমিতে কৃষিকাজ দেখাশুনা করতেন এবং আমাদের জমিতে যে সব কৃষি শ্রমিক কাজ করত, তাদের কাছেও তিনি খুবই প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমাদের বাড়িতে বার্ষিক হিসেবে নিয়মিত ৫-৬ জন লোক কাজ করত, তাদের পরিচালনা ও দেখাশোনাও তিনি করতেন। আমাদের গ্রামে সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। সমাজের প্রধান হিসেবেও মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আমার বাবা দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের বাড়ির সামনে জামে মসজিদ, ফোরকানিয়া মাদরাসা, স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থানের জন্য তিনি জমি দান করে গেছেন। তিনি একজন সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন। এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনি টেপিরবাড়ি কৃষক সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছিলেন। এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসেবে তিনি এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন। এই সমিতির মাধ্যমে এলাকার কৃষকরা সহজ শর্তে টাকা পেত ও কিস্তির মাধ্যমে কৃষক তার দেনা পরিশোধ করত। আমার বাবার নেতৃত্বে এই কৃষক সমবায় সমিতির মাধ্যমে সঞ্চয় সংগ্রহ করে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজন মোতাবেক কৃষকদের মধ্যে কৃষি সামগ্রী বিতরণ করা হত। এতে অনেক দরিদ্র কৃষকও স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি নিজের ও এলাকার মানুষের জমিতে সেচের জন্য ১৯৮০ সালে নিজস্ব জমিতে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছিলেন। এই গভীর নলকূপ স্থাপনের সময় খরচ হয় প্রায় এক লক্ষ টাকা। যার সিংহভাগ তিনি নিজেই দিয়েছেন। তিনি একজন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ছিলেন। বিশুদ্ধ খাবার পানির চাহিদা মেটাতে তিনি ১৯৭৮ সালে আমাদের বাড়ীতে টিউবওয়েল স্থাপন করেছিলেন, এতে নিজের পরিবারের সদস্য ছাড়াও গ্রামের লোকজনদের পানীয়জলের সুব্যবস্থা হয়। তিনি সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসতেন। তিনি একজন বৃক্ষ প্রেমিক মানুষ ছিলেন, প্রতি বছর বর্ষাকালে তিনি ফলজ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের চারা রোপণ করতেন। রোপিত বৃক্ষের সংরক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়েও তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে তিনি আমাদের বাড়ীর চারপাশকে সবুজে শ্যামলে মনোরম পরিবেশে সাজিয়ে গেছেন। এলাকার অনেক দরিদ্র মানুষের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খচর তিনি গোপনে বা প্রকাশ্যে দিয়েছেন। ধর্মীয় শিক্ষা অর্থাৎ মাদ্রাসা ছাত্রদেরও তিনি আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন। এলাকার অসহায় মানুষের সহায়তার জন্য তিনি সর্বদা কাজ করে গেছেন। কিন্তু, তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। তিনি দান করতে কৃপণ ছিলেন না। কিন্তু, নিজ নাম প্রচারে তিনি বড়ই কৃপণ ছিলেন।
আমার বাবা একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো হা-হুতাশ করতেন না। তিনি একমাত্র আল্লাহর সাহায্য চাইতেন। তিনি খুবই খোদাভীরু ও পরহেযগার মানুষ ছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামায়াতের সাথে পড়তেন। ৯২ বছর বয়সেও তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক ছিল। তিনি ধর্মীয় বইপত্র স্বাভাবিকভাবে পড়তেন। মসজিদে তালিমে তিনি কিতাব পড়তেন। দীর্ঘ দিন তিনি আমাদের বাড়ির মসজিদে আযান দিয়েছেন। অর্থাৎ, তিনি মোয়াজ্জিনের কাজও করেছেন।
আমি দেখেছি, আমার বাবা সর্বদা আল্লাহর জিকির করতেন। অসুস্থ্য অবস্থাতেও তিনি তাইয়্যুম করে নামাজ পড়েছেন এবং সারা ক্ষণ আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিলেন। আমাদের কাছে তার একমাত্র চাওয়া ছিল- আমরা যেন মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন ভাল মানুষ হই। আমার বাবা আর কখনো ফিরে আসবেন না। আসা সম্ভবও নয়। কিন্তু, আমার বাবার একমাত্র চাওয়া, আমরা যেন ভাল মানুষ হতে পারি। সকলের কাছে দোয়া চাই, আমরা যেন ভাল মানুষ হিসেবে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে পারি। অসহায় মানুষের সহায়তায় যেন আমরা কাজ করে যেতে পারি। আল্লাহ আমার বাবাকে যেন ফেরদৌস বেহেশত দান করেন, আমীন।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক, লেখক ও সমাজসেবক, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, ঢাকা