নিজস্ব প্রতিবেদক: চির উৎসবের দেশ বাংলাদেশ। নানা ধর্মের নানা মানুষ বছরজুড়ে হরেক রকমের আয়োজনে মেতে উঠেন। বাঙালির সেই ধারা বদলায়নি প্রবাস-পরবাসেও। কেবল সময় এবং স্থান পাল্টেছে। বাকি আনন্দ-আয়োজন, উৎসবে মেতে ওঠার দৃশ্য একই। বলছিলাম নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিদের কথা। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে কমিউনিটিতে চলছে সরব প্রস্ততি। দেশিয় উৎসব, সাংস্কৃতিক মিলনমেলা, ভোজন এবং ভাববিনিময়—সবই থাকছে এবারের পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনের আয়োজনে।
জ্যাকসন হাইটস, ব্রঙ্কস, জ্যামাইকা কিংবা ব্রুকলিন; সব স্থানের প্রবাসী বাঙালিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে ঈদ উদযাপনের। দেশটিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনই মূলত এসব আয়োজন করে আসছে। যাদের হাত ধরে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি পৌঁছে গেছে সুদূর আমিরেকায়!
জানা গেছে, আগামী ৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল আজহা উদযাপন হবে। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রধান প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার, ব্রুকলিনের বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টার, কুইন্সের আল আমিন মসজিদ, ওজোনপার্কের আল আমান মসজিদ এবং ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদে। এছাড়া, নিউজার্সি, ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, শিকাগো, টেক্সাসসহ অন্যান্য রাজ্যের মসজিদগুলোতেও একাধিক ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ মানেই উৎসবের এক অনন্য রূপ। গরুর হাটে যাওয়া, দরদাম করে গরু কেনা, বাড়ির উঠানে বা খোলা মাঠে জবাই, এরপর মাংস সমান তিন ভাগ করে আত্মীয়, প্রতিবেশী আর গরিবদের মধ্যে বণ্টনের যে প্রাণবন্ত দৃশ্য। তা অনেকের শৈশব-কৈশোরের অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি। কিন্তু নিউইয়র্ক শহরের চিত্র একেবারেই আলাদা।
এখানে কোরবানি দেওয়ার সবচেয়ে সহজ ও প্রচলিত উপায় হলো স্থানীয় বাংলাদেশি মালিকানাধীন মুদি দোকান বা হালাল গ্রোসারিগুলোতে নাম লিখিয়ে দেওয়া। নির্দিষ্ট দিনে দোকান থেকেই প্যাকেট করা হালাল মাংস সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। কেউ কেউ আবার কিছুটা অতি উৎসাহ নিয়ে বন্ধু-বান্ধব মিলে খামারে গিয়ে নিজেরা গরু বাছাই করে, উপস্থিত থেকে কোরবানি সম্পন্ন করেন। তবে এখানেও মাংস ভাগ করা হয় তিন ভাগে। এক ভাগ নিজেরা রাখেন, আর বাকি দুই ভাগ আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
কিন্তু এখানে বড় সমস্যা দেখা দেয় বণ্টনের সময়। কারও বাসায় গিয়ে মাংস দিয়ে আসলেও অনেকে তা নিতে চান না। কারণ সবার ঘরেই কোরবানির মাংস থাকে। আবার এখানকার ফ্রিজিং সুবিধা সীমিত হওয়ায় অতিরিক্ত মাংস সংরক্ষণ করাও বেশ ঝামেলার বিষয়। তাছাড়া ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী এক ভাগের কম কোরবানি দেওয়া যায় না, ফলে কম খরচে সামান্য অংশগ্রহণের সুযোগও নেই।
এই শহরের কুইন্সের জ্যামাইকা, নিউজার্সি, পেনসেলভানিয়া, লং আইল্যান্ড—এমন নানা অঞ্চলে অবস্থিত খামারগুলো থেকেই মূলত কোরবানির গরু সরবরাহ হয়। বেশিরভাগ খামারের মালিক আরব বা স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত হলেও, সেখানে নিয়োগ পাওয়া মৌলভিরাই ইসলামিক বিধান মেনে কোরবানি সম্পন্ন করেন। অনেকেই ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কোরবানি করলেও গরুই মূল আকর্ষণ।
ঈদের সকালে পুরো পরিবার নিয়ে খামারে যাওয়ার একটা রেওয়াজও গড়ে উঠেছে। সেখানে দিনভর সময় কাটিয়ে প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট মাংস নিয়ে ফিরেন তারা। এরপর সেই মাংস নিয়ে শুরু হয় আরেক রকম দুশ্চিন্তা—কার কোথায় ভাগ যাবে, কে নিতে রাজি, কে থাকবে বাসায়। ঈদের ছুটির অভাবে অনেকে সাড়া পান না, আবার বাসার ছোট ফ্রিজে মাংস রাখার জায়গাও মেলে না।
তবু এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রবাসে থাকা মানুষদের উৎসাহে ভাটা পড়ে না। বিশেষ করে কমিউনিনিটির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আয়োজনে পুষিয়ে দেয় প্রবাসীদের। প্রতিবারের মতো এবারও নিউইয়র্কে ঈদ ঘিরে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন প্রবাসী সংগঠন আয়োজনে থাকছে ঈদ পুনর্মিলনী, নাচ-গান, বাঙালিভোজ, কবিতা, নাটক, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন, ও কুইজ প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সেতুবন্ধন তৈরি হয়।
প্রবাসী কমিউনিটি নেতারা বলেন, প্রবাসে বসবাস করা মানুষদের মাঝে ঈদের এই আয়োজন শুধু আনন্দের নয়, এটি আত্মিক বন্ধনেরও একটি বড় উৎস। নতুন প্রজন্ম এখানকার নানা সংস্কৃতির ভিড়েও যেন নিজেদের শেকড়কে মনে রাখে সেজন্য থাকে নানা আয়োজন। এ জন্যই প্রতিবছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করে থাকে সংগঠনগুলো।