শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

উদ্বেগ/ঋণের টাকায় ঋণ পরিশোধ করছে সরকার

শুক্রবার, এপ্রিল ৫, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: ‘সরকারের ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে বিদেশি ঋণও। বিদেশি ঋণ এরমধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থ বছরের জুলাই পর্যন্ত সরকার যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে, তা দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৩৪ শতাংশ। বর্তমানে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ দিয়ে পূর্বে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে সরকার। এটি সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক।’

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) হোটেল লেকশোরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।

ঋণ পরিশোধ করার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বক্তারা বলেন, ‘সরকার শুধু প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয় না, বাজেট সহায়তার জন্যও ঋণ নেয়। এভাবে দেশের অভ্যন্তর থেকেও ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, টাকার গায়ে কখনো দেশি কিংবা বিদেশি ঋণ লেখা থাকে না। ডলার যখন টাকায় রূপান্তর হয়ে যায়, তখন তা কোন খাতে ব্যবহার হচ্ছে, সেটি একমাত্র সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্য কেউ বলতে পারে না।’

তবে, সার্বিক প্রেক্ষাপট এটাই বলে দিচ্ছে যে, আমাদের ঋণ অর্থনীতি এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে, যেখানে সরকারকে কার্যত ঋণের টাকায় ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া, একটা প্রকল্পের জন্য যখন বিদেশি ঋণের বরাদ্দ আসে, তখন পুরো টাকা কিন্তু একসাথে ব্যয় হয় না। মূলত ঋণের বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় আমরা এখন এমন পথেই হাঁটছি।’

সংলাপের বিষয় ছিল দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন, সালেহউদ্দিন ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

মসিউর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং এরপর মধ্যপ্রাচ্যে সংকট। এক্ষেত্রে, আমরা চাপকে সব সময় চাপ হিসাবে গ্রহণ করিনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ না বাড়ালে উৎপাদনশীলতা বাড়বে না।’

রেহমান সোবহান বলেন, ‘শ্রীলংকা স্বল্পকালীন ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। রপ্তানি কমে আসায় এসব ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করতে পারেনি দেশটি। আফ্রিকার কিছু দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ আপাতত তেমন অবস্থানে নেই। কিন্তু, দেশে স্বল্প মেয়াদি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০-৫০ শতাংশ বেশি খরচ হচ্ছে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘তিন বছর পূর্বে মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গেল দেড় দশকে ঋণ করে বহু মেগা প্রকল্প করা হলেও তা মানুষের উন্নতিতে কাজে আসেনি। বরং, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। বেড়েছে বেকার। ঋণ বাড়লেও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়নি।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে। ফলে, খাতভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রকল্প থেকে একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে।’

মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এ অর্থনীতিবিদ। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচারের সাথে জড়িত থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘গেল দুই সপ্তাহে ঋণের বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। দায় পরিশোধের পরিসংখ্যান, সামষ্টিক অর্থনীতির নানা ধরনের ফলাফলের কারণে বিষয়গুলো এসেছে। এক্ষেত্রে, নীতিনির্ধারকদের অস্বীকার করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে সেটি আরো প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বলেন, অর্থনীতিবিদরা ঠিকমত বিশ্লেষণ করতে পারেন না, ভবিষ্যৎও বলতে পারেন না। উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা পেশাদার অর্থনীতিবিদদের নিয়ে প্রায়ই শ্লেষাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক কথা বলেন। আজ থেকে দুই বছর পূবে সিপিডিতে বসেই আমি বলেছিলাম, ২০২৪ সাল আমাদের জন্য কঠিন হবে। সেখানে দায়-দেনা পরিশোধে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। ২০২৫ সাল থেকে ঋণ পরিশোধে অস্বস্তি শুরু হবে। ২০২৬ সালে এটা আরো বাড়বে। ঋণের হিসাবে গাফিলতি আছে। এ হিসাবে এখনো বহু কিছু বিবেচনায় নেয়া হয়নি।’

বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, ‘যদি ১০০ শতাংশ ঋণ নিয়ে থাকে, তার ৮০ শতাংশ সরকারের, আর ২০ শতাংশ বেসরকারি খাতের। ব্যক্তি খাতের ঋণের অবস্থা গুরুতর। এ টাকা কেউ কেউ বিদেশে নিয়ে গেছেন। কেউ ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেছেন। কেউ দেশেই আনেননি। ফলে, বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের হিসাবটা গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘সরকার তো দেশের ভেতরেও ঋণ নিচ্ছে। সেই ঋণের পরিমাণ কত? যে ঋণ আমরা বিদেশ থেকে নিই, তার দ্বিগুণ আমরা দেশ থেকে নিই। সরকারের এখন যে ঋণের পরিমাণ, তার দুই-তৃতীয়াংশ অভ্যন্তরীণ ঋণ, সেটিই বড় ব্যাপার। সরকারের দায়-দেনা পরিস্থিতি বুঝতে হলে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণও দেখতে হবে। তিন বছর পূর্বে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে মোট রাজস্ব আয়ের ২৬ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করত সরকার।’

চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত তা প্রায় ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে দেশি ঋণ পরিশোধে ২৮ শতাংশ এবং বিদেশি ঋণে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। অর্থাৎ, ঋণ পরিশোধের দায় কত দ্রুত ও কী হারে বাড়ছে। তার মতে, বৈদেশিক ঋণের কারণে মাথাপিছু দায়দেনা যদি ৩১০ ডলার হয়, অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগ করলে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮৫০ ডলার।

দেবপ্রিয় আরো বলেন, ‘আমাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, সরকার রাজস্ব আয় থেকে উন্নয়ন প্রকল্পকে অর্থায়ন করতে একটা পয়সাও দিতে পারে না। আমরা প্রতারণামূলক বাস্তবতায় আছি।’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের ঋণ ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে। এক দিকে রাজস্ব আদায় কম, এরপর ঋণ পরিশোধের চাপ। এতে সরকার নতুন ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি ঋণ রয়েছে। সরকার যেসব ঋণ নিয়েছে, তার দায় রয়েছে। পাশাপাশি, বেসরকারি খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে, সরকার সেই ঋণের গ্যারান্টিও দিয়েছে। এ ঋণের দায় পরিশোধের জন্য ফের ঋণ নিতে হচ্ছে। তাই, দ্রুত অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই।’

তার মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বহু বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক নয় বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিদেশি ঋণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২১ দশমিক ছয় শতাংশ। অন্যান্য দেশের সাথে তুলনামূলক বিচারে এ হার বেশি নয়। কিন্তু, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

এছাড়া, ঋণ পোর্টফোলিওর গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, অন্য দিকে, রেয়াতি ও বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্তাবলিও আরো কঠোর হচ্ছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সাথে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতার দ্রুত বৃদ্ধি উদ্বেগজনক।

মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। এর সাথে ঋণ বহনের সক্ষমতা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ দেশি ও বিদেশি ঋণের মূল ও সুদ পরিশোধে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

সালেহউদ্দিন বলেন, ‘ঋণের ফাঁদ নিয়ে বহু কথাবার্তা এসেছে। কিন্তু, ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প করা হচ্ছে, তার যৌক্তিকতা বিবেচনা করা জরুরি। প্রকল্পগুলো থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবে, তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কিনা সেটি দেখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ নিয়ে কথা আসছে। কিন্তু, আইএমএফ যেসব পরামর্শ দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হল সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সুদের হার বাড়ানো অন্যতম।’

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জুনায়েদ সাকি, এশিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ।