কাজী ছাব্বীর: ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ এখন জাতীয় বইমেলায় পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি ও ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারী হলেও এই বইমেলা আন্তর্জাতিক বই মেলার স্বীকৃতি লাভ করেনি এখনো। ভাষা শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এই বইমেলার মূলমন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারিভাবে এই বই মেলার আয়োজন করে থাকেন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারী চিত্তরঞ্জন সাহা বর্ধমান হাউজের সামনে বটতলায় চটের উপরে বসে ছোট আকারে বইয়ের দোকান সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন এককভাবে। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি এককভাবেই বই মেলা চালিয়ে যান বলে তথ্য সূত্রে জানা যায়। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমিকে বই মেলার সাথে যুক্ত করেন। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রথম অমর একুশে গ্রন্থ মেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন। তেঁতো বাস্তবতা হল স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষা ভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রদের উপরে ট্রাক তুলে দিয়ে দুইজন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় সে বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী ১৯৮৪ সালে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ শুরু হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বাঙালি জাতির সবচাইতে বড় ও দেশের ঐতিহ্য বহন করে বাংলাদেশের এই বইমেলা।
সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে দেশের জনজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ করে দেয় লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনে এ ধরনের লেখাই প্রকাশিত হয়, যেখানে সমাজের সংস্কার নিয়ে লেখকের নিজের পর্যবেক্ষণ ও মৌলিক ভাবনা প্রতিফলিত হওয়া দরকার ও লিটল ম্যাগাজিনের মাহাত্ম মূলতঃ এখানেই। লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরেই আবির্ভাব ঘটেছে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার। বাংলা ভাষায় আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির চর্চাও চলছে লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরেই। প্রগতিশীল চিন্তার সূত্রপাত হয় লিটল ম্যাগাজিনের গর্ভেই। লিটল ম্যাগাজিনই বাতলে দেয় সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি। সাহিত্যে যত ধরনের আন্দোলন হয়েছে, যে-আন্দোলনকে বলা যায় সাহিত্যের প্রাণশক্তি, নতুন নতুন ভাবনা আর নানাভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সাহিত্য এভাবেই এগিয়ে চলে, দৈনন্দিন নতুন নতুন রূপে নবায়িত হয়ে ওঠে, লিটল ম্যাগাজিনই নিবিড়ভাবে সেই আন্দোলনে পুরোধা ভূমিকা পালন করে আসছে।
আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে সাহিত্যের যত রূপ-রস সব কিছুরই অঙ্কুর লিটল ম্যাগাজিন। অতীতের ন্যায় বর্তমানেও প্রবীন কিংবা মুখচেনা লেখকদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী হলেও নবীনদের লেখা ছাপাতে বরাবরই অনাগ্রহ দেখা যাচ্ছে কিছু বহু প্রচারিত দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় বাণিজ্যিক কারণে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকাগুলিতেও স্থান পায় না নবীন লেখকদের লেখাগুলি। বাংলা সাহিত্যকে দেশের দর্পণ বা মননের উৎস যাই বলা হোক, সাহিত্যের গোড়াপত্তন বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের হৃদয় গভীরে। আর যা প্রকাশ পায় লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই।
সমাজে যা কিছু পরিবর্তনশীল, সৃষ্টিশীল ও মননশীল সবকিছুরই বুননক্ষেত্র হল লিটল ম্যাগ্যাজিন। তাই বাংলা সাহিত্যকে আরো বেগবান করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে, রক্ত ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর মনোযোগী করতে, নবীন লেখকদের নব-ভাবনা, শৈল্পিক চিন্তা চেতনার প্রতিভা বিকশিত করার লক্ষ্যে, বাংলা সাহিত্যের দিকে আরো বেশি মনোযোগী করার অভিপ্রায়, লিটল ম্যাগাজিনকে সরকারীভাবে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। নিয়মিত লিটন ম্যাগাজিন প্রকাশের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাহলেই লিটল ম্যাগাজিন হয়ে উঠবে আগামীর প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্যিক তৈরীর মুক্ত মঞ্চ। বাংলা সাহিত্যের বুননক্ষেত্র এই লিটল ম্যাগাজিন ছাপাতে বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে থাকেন সাহিত্যপ্রেমী লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশক ও সম্পাদকগণ। এই ম্যাগাজিনগুলি প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যের প্রচার করে আসছেন লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশকরা প্রায় বিনামূল্যেই।
রাজনৈতিক খবর বা উল্লাসিত হওয়ার মত রঙ লাগানো কোন সংবাদ না থাকায় সাহিত্যের কাগজগুলি কেউ কিনে না। অপর দিকে, একমাত্র অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৫০০ টাকার বিনিময় বাংলা একাডেমি কর্তৃক চার ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি করে স্টল পেয়ে থাকেন লিটল ম্যাগাজিনের কর্তৃপক্ষর। গ্রন্থ মেলায় এক মাসে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল প্রতি খরচ হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অনেকের পক্ষেই বিনা লাভে এই ব্যায়ভার বহন করা সম্ভব না হওয়ায় লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কেউ কেউ। বই মেলায় প্রতি বছর জায়গা স্থানান্তরিত হওয়াও লিটল ম্যাগাজিন পিছিয়ে পড়ার জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও বাংলা একাডেমির বই মেলায় আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অঙ্কুর বা গোরাপত্তন লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের স্থানটি স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করতে ব্যার্থ হয়েছে বাংলা একাডেমি ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজক কমিটি। সরকার কর্তৃক আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে স্তর ভিত্তিক সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন/সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগ নিলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নবীন লেখকদের লেখা ছাপানো, নির্বিঘ্নে প্রতিভা বিকাশের দ্বার উন্মোচিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, দেশব্যাপী গ্রামে গঞ্জে বাংলা সাহিত্য বিকাশে আরো ব্যাপ্তি ঘটবে। তৃণমূলে সাহিত্য চর্চার এমন ক্ষেত্র থাকলে তরুণরাও হয়ে উঠবে মেধাদীপ্ত ও সৃজনশীল। সংগত কারণে সমাজে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে উন্নতির প্রতিফলন ঘটবে আশানুরূপভাবে।
সাহিত্য সমাজ বদলে, দিন বদলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সমাজের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে গবেষণামূলক নতুন ভাবনার ক্ষুরধার লেখনি আসে নবীন লেখকদের কলমে। সমাজ সংস্কারে নবীন লেখকদের লেখনি বেশ প্রতিবাদীও হয় বটে। লিটল ম্যাগাজিনের উন্নতি না ঘটাতে পারলে দেশে নতুন ও মেধা সম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরিতে বাধাগ্রস্থ হবে দুঃখজনক হারে। ফলে সমাজের সংস্কার থেমে যাবে। প্রতিনিধিত্বশীল লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজের স্বার্থকতা বা ব্যার্থতা কোনটা নিয়েই সরকার মাথা ঘামায় না। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে বিভিন্ন প্রতিকুলতায় শীকার হতে হয়। অর্থনৈতিক সংকটতো বটেই। বড় কাগজ না হওয়ায় বিজ্ঞাপন না থাকায়, পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায়, অস্বাভাবিকভাবে কাগজের মূল্য বৃদ্বি পাওয়া, লিটল ম্যাগাজিন পিছিয়ে পরার অন্যতম কারণ।
বাংলা সাহিত্যের গুণগত মানোন্নয়নে লিটল ম্যাগাজিনকে বাঁচাতে সরকারকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশকরা বই মেলায় লিটল ম্যাগ স্টল বরাদ্দ পেলেও ঢাকায় এসে অর্থের অভাবে স্টল পরিচালনা করা সম্ভব না হওয়ায়, অনেকেই স্টল খুলতে পারে না। প্রতি বছরই বই মেলার শেষ প্রান্তে এসেও দেখা যায় যে, বহু স্টলই খোলা হয়নি। তাই সাহিত্যের গোড়াপত্তন লিটল ম্যাগাজিনকে বাঁচাতে হলে সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে লিটল ম্যাগাজিনকে এই ভঙ্গুর দশা থেকে উত্তরনের জন্য লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তার একটা বিহীত ব্যবস্থা নিতে সরকারের দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়ন ও মেধা বিকাশের স্বার্থে লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প নেই।
শুদ্ধ সাহিত্য চর্চা এবং কবি ও সাহিত্যিক তৈরির মূলক্ষেত্র হল লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনগুলি সময়ে সময়ে সাহিত্য আসর অনুষ্ঠান করে থাকে। এতেও সমাজের বিত্তশালীদের অংশগ্রহণ তেমন চোখে পড়ার মত নয়। সাহিত্যপ্রেমীরা মাথাপিছু কিছু কিছু অনুদান দিয়ে নিজেরাই এসব অনুষ্ঠানের ব্যায়ভার বহন করে থাকেন। লিটল ম্যাগাজিন না থাকলে অজপাড়াগাঁয়ের উঠতি বয়সের নতুন নতুন লেখকেরা তাদের লেখা কোথাও ছাপাতে না পারার কারণে, এরা ধীরে ধীরে বিমুখ হয়ে পরবে সাহিত্য জগৎ থেকে। ফলে, বাংলা সাহিত্য এক দিন মেধাশুন্য হয়ে পরার আশংকা রয়েছে।
বাংলা সাহিত্য চর্চার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল লিটল ম্যাগাজিন। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকায়নের শুভ যাত্রা ঘটে লিটল ম্যাগাজিন থেকে। আর সেই লিটল ম্যাগাজিন চত্বরটি বইমেলায় খুবই গরীবি হালতে সজ্জিত করা হয়ে থাকে, যা দেখলে সুস্পস্ট মনে হয় যেন লিটল ম্যাগাজিন সবচাইতে অবহেলিত। প্রতিটি স্টলে একটি চেয়ার ও দুইটি স্টলে মিলে একটি বৈদ্যুতিক বাতি। রাস্তার পাশে ফুটপাতের দোকানের মত খোলা আকাশের নিচে এক চিলতে বসার জায়গা। বৃষ্টি-বাদল, ঝর-তুফানে মুহুর্তের মধ্যেই উড়ে যাবে সাহিত্য প্রেমীদের সর্বশেষ আশা-আকাক্সক্ষার ভরসার জায়গা টুকু।
অপর দিকে, বইমেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও লিটল ম্যাগ চত্বরের কাজ শেষ হয় না কোন বছরেই। এক কথায় বলতে গেলে, সরকারের অবজ্ঞা আর অবহেলায় প্রায় প্রাণহীন হয়ে পড়েছে লিটল ম্যাগ চত্বর। নানা কারণে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পরেছে। অনেক বড় বড় কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের উত্থ্যান লিটল ম্যাগাজিনের গর্ভে। বড় বড় জাতীয় পএিকাগুলি বাণিজ্যিক কারণে নতুন লেখকদের লেখা না ছাপালেও লিটল ম্যগাজিন সেগুলি অতিযত্ন সহকারে ছাপিয়ে সাহিত্যের বিকাশ ঘটানোর প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে। বাংলা সাহিত্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে আরও গুরুত্ববাহী করে তোলা, নতুন লেখকদের সাহিত্যের প্রতি আরো মনোযোগী করার লক্ষ্যে ও তাদের মেধা বিকাশ ঘটানোর স্বার্থে নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে লিটল ম্যাগাজিনের, ভঙ্গুর দশা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সুনজর দেয়া প্রয়োজন।
লেখক: কবি, ঔপন্যাসিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী।