মো. গনি মিয়া বাবুল: যত দিন একুশের প্রভাত ফেরিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গাওয়া হবে, তত দিন আবদুল গাফফার চৌধুরী অমর হয়ে থাকবেন। এ অমর গানের রচয়িতা গত ১৯ মে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলায় জন্ম, এ মাটিতেই চির নিদ্রায় শায়িত হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থনে স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে তাকে। ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্ম নেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। সোমবার (১২ ডিসেম্বর) তার ৮৮তম জন্মদিন; মৃত্যুর পর এটাই তার প্রথম জন্মদিন।
একাধারে সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি, সাহিত্যিকের মত বহু গুণে গুনান্বিত হলেও তার ব্যাপক পরিচিতি একুশের গানের রচয়িতা ও কলামিস্ট হিসেবে। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তার ভাবনা জুড়ে ছিল বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ। আর তাই সুদূর বিলাতে বসেও বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তার রাজনৈতিক বিশ্লষণের সাথে কারো কারো ভিন্নমত থাকলেও লেখনির মুন্সিয়ানা নিয়ে কেউ প্রশু তুলতে পারে নি।
ডানপিটে শওকত, কৃষষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, সুন্দর হে সুন্দর, চন্দদ্বীপের উপাখ্যান, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ এর মত বহু গ্রন্থের লেখক হয়েও চূড়ান্তভাবে কলামিস্ট হিসেবে নাম লেখানোর কারণ হিসেবে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মন্তব্য ছিল- রুটি-রুজি। অর্থাৎ জীবিকার তাগিদে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিকতা পেশা দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করলেও মাঝখানে ব্যবসায়ে নেমেছিলেন। যার জন্ম কলম চালানোর জন্য, তাকে দিয়ে পুঁজি চালানো চলে! অল্প দিনের ব্যবধানে ফের ফিরে এসেছিলেন সাংবাদিকতায়। ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে কবি হিসেবেও খ্যাতি পেতে পারতেন তিনি। শুধু আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো নয়, তার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একসময়ের স্রোতমান নদী লালগঞ্জ নিয়ে তার লেখা ‘লালগঞ্জের তীরে সহৃর্যোদয়’ এর সাক্ষ বহন করে।
উলানিয়া জমিদার পরিবারে জন্ম নিলেও আর্থিক অনটনের যাতনা কৈশোর থেকেই মোকাবিলা করতে হয়েছে। ১৯৪৬ সালে বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাকে চলে যেতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইন্সটিটিউটে। এর আগে উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় (বর্তমানে উলানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বরিশাল শহরে গিয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ছাত্র জীবনেই সাহিত্য চর্চা শুরু; ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ কিভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়, সে কথা সবারই জানা।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবনের সেরা কীর্তি। এ গান নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরাসি দার্শনিক আঁন্দো মারলো ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি একুশের গানটি শুনে খুশি হয়ে এর রেকর্ড সাথে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু গাফফার চৌধুরীকে বলেন, তুমি স্বাধীনতা নিয়ে ওই রকম একটি গান লিখ। জবাবে তিনি বলেছিলেন, আপনি ৭ মার্চের মত আরেকটি ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু হেসে দিয়ে বলেছিলেন, তা কি আর সম্ভব! গাফফার চৌধুরীও বলেছিলেন, আমার পক্ষেও স্বাধীনতা নিয়ে ওই রকম লেখা সম্ভব নয়।
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বিলাতে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। ২০১২ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর শোক তাকে সহ্য করতে হয়েছে; নিজের মৃত্যুর কিছুদিন আগে কন্যা বিনিতা চৌধুরীর মৃত্যু তার শোক আরো বাড়িয়ে দেয়। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত আবদুল গাফফার চৌধুরীর ৮৮তম জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক, কলাম লেখক ও সংগঠক, ঢাকা