চট্টগ্রাম: ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট ও লোৎসের চুড়ায় উঠে যখন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছি, তখন ওপরে ওঠার সব কষ্ট ভুলে গেছি। হিমালয়ের এভারেস্ট ও লোৎসের চূড়ায় দেশের পতাকা ওড়াতে পেরে আমি গর্বিত।’
হিমালয়ের দুইটি আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ জয় করে মঙ্গলবার (২৮ মে) রাতে দেশে ফিরে বুধবার (২৯ মে) দুপুরে সেই দুঃসাহসী অভিযানের গল্প শোনালেন চট্টগ্রামের সন্তান বাবর আলী। চট্টগ্রাম সিটির চকবাজারের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য চট্টগ্রামের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাবরের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
এতে উপস্থিত হয়ে বাবর আলী বলেন, ‘আমি গেল ১৯ মে পৃথিবীর শীর্ষ পর্বত এভারেস্ট ও ২১ মে চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসে আরোহণ করে দেশের লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছি। এভারেস্টের চুড়ায় প্রায় দেড় ঘণ্টার মত অবস্থান করেছি। নেমে আসার সময় এক আহত পর্বতারোহীর জন্য সৃষ্ট মানবজটে প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলাম। ওই উন্মুক্ত এলাকায় হঠাৎ শুরু হয় তুষারঝড়। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বড় কোন দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্প-৪ এবং এর ওপরের এলাকায় পর্বতারোহীরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও আমি চেষ্টা করেছি অভিযানে যতটা সম্ভব কম কৃত্রিম অক্সিজেন নিতে। কারণ, আমি স্বপ্নে দেখি আগামীতে অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই কোন আট হাজারের শৃঙ্গ আরোহণ করব। দুই পর্বতে আমার সাথী ছিলেন নেপালের গাইড বাইরে তামাং।’
বাবর আরো বলেন, ‘এভারেস্টের উচ্চতা বেশি হলেও লোৎসে আরোহণ তুলনামূলক কঠিন। এভারেস্ট ও লোৎসে শিখর থেকে দেখা নিচের পৃথিবীর দৃশ্য। এটি জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এভারেস্টর চুড়া থেকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লেগেছে তিব্বতকে। যা ভুলার নয়।’
এ পর্বতারোহী বলেন, ‘সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছি, এটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। চার কেজি ওজন কমেছে। এভারেস্টে বহু লাশ দেখেছি। কিন্তু, আমি মনোবল হারাইনি। এর মধ্যে বহু ইক্যুইপমেন্ট নতুন, তারা মারা গেছে বেশিদিন হয়নি। এভারেস্ট সামিট করার ক্ষেত্রে আবহাওয়া বড় ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের একজন আবহাওয়াবিদ আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন।’
বাবর আলী বলেন, ‘দুই মাসের অভিযান। আজ এভারেস্ট ডে। ১৯২৪ সালে জর্জ মেলোরির মহাকাব্যিক অভিযান ছিল। ১০০ বছর পর আমি এভারেস্ট আরোহণ করতে পেরেছি। আমাদের ভার্টিকাল ড্রিমস ক্লাব দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। গেল ১০ এপ্রিল বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছি। কুমু আইসফলের (বরফের প্রপাত) রাস্তা তখনো ওপেন হয়নি। এ সড়কটি অ্যালুমিনিয়াম সিঁড়ি দিয়ে পার হতে হয়। প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। একজনকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করতে হয়েছিল। এবার ব্লু আইস বেড়ে যায়। কেউ যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং দেখতে চায়, তাকে হিমালয় যেতে হবে। হিমালয়ে প্রচুর সুন্দর লেক।’
‘এভারেস্ট জয় করার চেয়ে কঠিন এর জন্য তহবিল জোগাড় করা, পৃষ্ঠপোষক পাওয়া। আমি এবার স্পন্সরের কাছে গেছি। আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার জন্য বিকাশে ২৫ টাকা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন এমন লোকও আছে। আমি সকলে সহযোগিতায় ভালবাসায় এভারেস্ট এবং লোৎস জয় করতে পেরেছি। আমি মনে করি, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের বহু তরুণ এভারেস্ট জয় করতে পারবে।’
এ অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান বলেন, ‘পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা পেলে ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরা আরো বহু দুর্দান্ত কীর্তি বয়ে আনতে পারবে।’
এ দিকে, বাবর আলীর সফলতা উদযাপনে ২ জুন বিকাল পাঁচটায় চট্টগ্রাম সিটিতে অনুষ্ঠিত হবে চট্টগ্রামের সাইক্লিস্টদের অংশগ্রহণে সাইকেল শোভাযাত্রা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বাবর আলী নিজের অভিযানের গল্প শোনাবেন চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির অডিটোরিয়ামে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সভাপতি দেবাশীষ বল, প্রধান উপদেষ্টা শিহাব উদ্দিন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএন ফয়সাল।
মঙ্গলবার (২৮ মে) নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিকালে আসার পর রাতেই চট্টগ্রামে পৌঁছান বাবর আলী।
গেল ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশে রওনা দেন বাবর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের দুই দিন পর লোৎসে পর্বতের শীর্ষ (আট হাজার ৫১৬ মিটার) ওঠেন ৩৩ বছর বয়সী বাবর আলী। ২১ মে নেপাল সময় সকাল পাঁচটা ৫০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ছয়টা পাঁচ মিনিট) বাবর লোৎসে পর্বতে পা রাখেন। নেপালের স্নোয়ি হরাইজন নামের ট্রেকিং ও পর্বতাভিযান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানে যান বাবর।