অভ্র বড়ুয়া: ভারতের উত্তরবঙ্গের কালিম্পংয়ের পাহাড়ের কোলে নয়নাভিরাম পরিবেশে অবস্থিত কুমুদিনী হোমস সরকারী বিদ্যালয়। অনেকেই এ বিদ্যালয়ের নাম সম্পর্কে অবগত নয়। তবে এ বিদ্যালয়ে রয়েছে ২১ জন ছাত্রের অনবদ্য এক ‘পাইপস অ্যান্ড ড্রাম’ এর দল। যারা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চর্চার মধ্যে দিয়ে প্রথম কোন অসামরিক ছাত্রদের দল হয়ে নিজেদের প্রতিভাকে তুলে ধরেছে বিশ্বের সামরিক ব্যান্ডদল নিয়ে আয়োজিত ‘বাসেল ট্যাটুর ১৫তম অধিবেশনে। পাইপ, ড্রাম ও অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতের সংমিশ্রণে সামরিক রূপকে ট্যাটু বলা হয়। পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় সামরিক ব্যান্ড হল বাসেল ট্যাটু। সুইস ফেডারেল প্রতিরক্ষা বিভাগের আমন্ত্রণে বাসেল ট্যাটুর ১৫তম অধিবেশনে এ বছর অংশ নিয়েচে কালিম্পংয়ের পাইপস অ্যান্ড ব্যান্ড দলের ২১ জন মেধাবী ছাত্র।
বাসেল ট্যাটু মূলত আন্তর্জাতিক স্তরে সামরিক ব্যান্ড, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও ট্যাটু গঠনের জন্য অন্যতম মঞ্চ। আনুমানিক এক লাখ ২৫ হাজার জন দর্শক সমাবেশ ঘটে, যেটাকে বিশ্বের বৃহত্তম অনুষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কুমুদিনী হোমসের এ ব্যান্ড দলকে আমরা আমাদের দার্জিলিংয়ের স্কুল এফএলএসে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এ আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে ভারতের দশটি ভিন্ন প্রদেশ থেকে মেধাবী খেলোয়ার অংশ নেয়। কুমুদিনী হোমসের ‘পাইপস অ্যান্ড ব্যান্ড দল’ সাদরে আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বিশাল এ আনন্দ আয়োজনে সব কয়টি সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যে তাদের পরিবেশনা সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী ও প্রাণবন্ত ছিল। অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক হিসেবে আমার সুযোগ হয় ব্যান্ড দলের ইনচার্জ প্রিয়দর্শী লামার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার। তিনি বলেন, ‘সমাজের পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের পড়ার সুযোগ করে দিতে ও তাদের স্বপ্নের পথে হাটতে কুমুদিনী হোমস প্রতিষ্ঠিত হয় ৪০ এর দশকে। এটি ভারতের উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন ও খ্যাতনামা সরকারী বিদ্যালয়। স্কুল খুব সীমিত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে ছাত্রদের। ব্যান্ড দলের প্রতিটি সদস্য অত্যন্ত মেধাবী, কঠোর পরিশ্রমী, সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যায়।’ প্রিয়দর্শী এক পর্যায়ে আবেগে বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে দিনে ৬-৭ ঘন্টা তারা অনুশীলন করে থাকে, কখনো ডাল ভাত খেয়ে কখনো শুধু পানি পান করেই অনুশীলনে ব্যাস্ত থাকে। তাদের তীব্র আকঙ্খা ও ইচ্ছাশক্তি সব প্রতিকূলতাকে জয় করতে সক্ষম।’
যন্ত্র ভীষণ নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও তাদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে তারা আজ বিশ্ব সেরা। গোর্খা সুরের মেলবন্ধনে ব্যাগপাইপ গঠনের পাশাপাশি, ব্যান্ডটি বিখ্যাত ‘খুকরি নাচ’ পরিবেশনে বেশ দক্ষ। কুমুদিনীতে ব্রিটিশদের হাত ধরে পাহাড়ের বুকে সামরিক ব্যান্ড মিউজিক চালু হয় ও কুমুদিনীই সে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি; যেখানে ছাত্ররা ‘ব্যান্ড’ ঘরানার সংগীতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল ১৯৬০ এর দিকে। যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জীর্ণ অবস্থায় পড়েছিল কুমুদিনী হোমস ব্যান্ডটির বাদ্যযন্ত্রগুলি। ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিল ব্যান্ডটিও।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুমুদিনী হোমসের বাণিজ্য বিভাগে প্রিয়দর্শী লামা যোগ দেযার পরই তাদের ভাগ্য খুলে যায়। এ তরুণ শিক্ষক ছিলেন যেমন উদ্যমী, পরিশ্রমী তেমনি সংগীতপ্রেমী। শিক্ষকের পাশাপাশি ছাত্রদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক। যে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেই এগিয়ে যেতেন প্রিয়দর্শী। তিনিই নিজেই দায়িত্ব নেন তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার।নিরবিচ্ছিন্নভাবে অভাব ও নিম্নমানের ব্যান্ড থাকা সত্ত্বেও থামেনি ছাত্রদের প্রশিক্ষণ। কোন কিছু অর্জন বা শেখার প্রতি কঠোর পরিশ্রম কিংবা প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে তা কখনো বৃথা যায় না, কুমুদিনীর ব্যান্ড দলের ছাত্রদের ক্ষেত্রেও তেমনটা হল। ২০১৪ সালে, কালিম্পংয়ের এ স্কুল ব্যান্ডটি ব্যাসেল ট্যাটুর আয়োজকদের নজরে কাড়ে। তবে তারা প্রথম ডাক পায় ২০১৯ সালে, দুর্ভাগ্যবশত করোনা মহামারীর কারণে স্থগিত হলে ২০২২ সালে ব্যাসেল ট্যাটু চারটি মহাদেশের প্রায় এক হাজার অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে আয়োজন করেছে এ অনুষ্ঠান, যার মধ্যে ‘ব্যান্ড অফ হার ম্যাজেস্টিস ওয়েলশ গার্ডস’ও রয়েছে৷ বছরের বার্ষিকী সংস্করণে ২২টি ইউরোপীয় সামরিক ব্যান্ডের মধ্যে জায়গা পেয়েছে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের কুমুদিনী ব্যান্ডটি। ব্যান্ডদলের একেবারেই তরুণ সদস্যরা সকলেই প্রায় কালিম্পংয়ের গ্রামীণ ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির পরিবারের সন্তান। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সেখানে সুইজারল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আমন্ত্রণ তাদের কাছে অধরা স্বপ্নের মতো হাজির হয়। যাত্রার পরিকল্পনা করা একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল। ব্যান্ডের ইনচার্জ প্রিয়দর্শী মহোদয় কখনো হাল ছেড়ে দেন নি। তিনি ছায়ার মতে ছাত্রদের পাশে ছিলেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রবল আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল ছাত্রদের। তবে শেষ অবধি কুমুদিনীর ছাত্রদের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয় ও তারা সুইজারল্যান্ডের মাটিতে পা রাখেন তাদের প্রতিভাকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরতে। দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা তাদের পাশে আলো হয়ে দাঁড়ান।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর ব্যান্ডের মধ্যে তারাই একমাত্র অসামরিক ছাত্রদের ব্যান্ডদল, যাঁদের প্রত্যকের বয়স ১৫-১৮ এর মধ্যে। তাদের পরিবেশনার পূর্বমুহূর্তে সুইস নির্দেশকরা কালিম্পংয়ের স্কুল ব্যান্ডটিকে দর্শকদের সামনে গর্বে ও সম্মানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে সুইস আয়োজকরা বলেন, ‘এ বছর আমরা আরো ভালভাবে অনুষ্ঠানটি উদযাপন করতে চলেছি। বাসেল ট্যাটুর ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য আমরা আয়োজন করতে চলেছি ব্যাগপাইপের উপস্থাপনা। পরিবেশন করবে ভারতের কালিম্পংয়ে কুমুদিনী হোমস স্কুল পাইপস অ্যান্ড ড্রামস ব্যান্ড। যার মাধ্যমে আপনারাও নিজেদের অনায়াসে ভাসিয়ে দিতে পারেন স্কটিশ শব্দ ও প্রাচ্যের সুরের আবহে।’
প্রিয়দর্শী লামার যথাযথ দিকনির্দেশনা ও ছাত্রদের সংগীতের প্রতি অনুরাগ তাদের আজ সাফল্যের চুঁড়ায় নিয়ে গেছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হল- তাদের পরিবেশেনায় মুগ্ধ হয়ে আমেরিকার সামরিক বাহিনী তাদের সব বাদ্যযন্ত্র উপহার হিসেবে দিয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিন ব্যান্ডের মধ্যে কুমুদিনী ব্যান্ড দল অন্যতম। তবুও, এখনো তাদের জীবনে অভাবের ছায়া রয়েছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তারা সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে তাদের ও দেশের নাম উজ্জ্বল করবে বলে আমি মনে করি।
লেখক: ভারতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থী।