নিউইয়র্ক: কুইন্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে নেতৃত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নের উপর শনিবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে অনুষ্ঠান করেছে নোলক ফাউন্ডেশন। ‘উইমেন এমপাওয়ারিং উইমেন’ থিমে আয়োজিত এই ইভেন্টে কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরির প্রধান লাইব্রেরিয়ান ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক ব্যুরন এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সমাজসেবী ও কমিউনিটি নেত্রী রাহাত হোসেনকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি নারীদের আত্মনির্ভরতা, সামাজিক উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীর ভূমিকা নিয়ে গভীর আলোচনার প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।
লেখিকা ও নারী নেত্রী রাজিয়া নাজমীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয় তাঁর চিন্তা উদ্রেক করা বক্তব্য দিয়ে।
তিনি বলেন, ‘একটি শিশু জন্ম নেয় মেয়ে বা ছেলে হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে। তাদের সমঅধিকার জন্মগত। আমাদের সমাজের দায়িত্ব সেই অধিকার নিশ্চিত করা।’
রাজিয়া নাজমী জোর দিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতায়নের মূল স্তম্ভ হলো শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ। নারীকে এই তিনটি ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে পারলেই কেবল সমতা সম্ভব।’
প্রধান অতিথি রাহাত হোসেইনের জীবনসংগ্রাম ও সামাজিক অবদান অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। রাজিয়া নাজমীর প্রশ্নোত্তরে উঠে আসে তাঁর সাহসী নেতৃত্বের গল্প। উত্তর আমেরিকায় প্রথম নারী হিসেবে মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী রাহাতের কোভিড-১৯ মহামারিতে ভার্চুয়াল জামাত চালুর সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন রাজিয়া।
‘মহামারির শুরুতেই তিনি ধর্মীয় রীতি ও স্বাস্থ্যবিধির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, যা মুসলিম কমিউনিটিকে নিরাপদ রাখতে ভূমিকা রেখেছে।’ বলেন তিনি।
রাহাত হোসেইনের পরিবার বাংলার সমাজসেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর পিতা শহীদ ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ও মানবতার সেবক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্তব্যকালীন অবস্থায় শহীদ হয়েছিলেন। রাহাত হোসেইনের মাতা হোসনে আরা আহমেদ সিলেট মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। তার ভাই প্রফেসর ডাক্তার জিয়াউদ্দিন আহমেদ ফিলাডেলফিয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধ।
অনুষ্ঠানে রাহাত বলেন, ‘আমার বাবা-মা শিখিয়েছেন, সম্পদ মানুষের সেবায় ব্যয় করাই প্রকৃত সফলতা। আমরা কবরে টাকা নিয়ে যাব না, কিন্তু আমাদের কাজ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।’
নিক ব্যুরনকে সম্মাননা জানানো হয় শিক্ষা ও সম্প্রদায় উন্নয়নে তাঁর অগ্রণী ভূমিকার জন্য। তিনি বলেন, ‘লাইব্রেরি শুধু বইয়ের ভাণ্ডার নয়, এটি সামাজিক সংলাপ ও নেতৃত্ব বিকাশের কেন্দ্র। নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য আমরা নিরন্তর কাজ করছি।’
প্রায় দুই ঘন্টার আলোচনায় উঠে আসে মানবাধিকার ও নারী অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ সব বার্তা।
বক্তারা বলেন, ‘ধর্ম ও আধুনিকতার সমন্বয় করে রাহাত হোসেনের ভার্চুয়াল জামাত প্রমাণ করে, ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার করে কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিউনিটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল কভিডের আক্রমণের সময়ে।’
সেলিনা শারমিন তার কথামালায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মাইক্রো-লোন প্রোগ্রাম এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
রাহাত হোসেইনের জীবনসঙ্গী সৈয়দ জাকি হোসেইন বলেন, ‘পরিবার ও সমাজের দ্বৈত দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘নারীরা যখন বাড়ি ও বাইরে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তখন পরিবারকেই হতে হয় তাঁর প্রধান সমর্থক।’
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত ছিল যখন রাহাত হোসেইন ও তাঁর পরিবারের দাতব্য কর্মকাণ্ডের গল্প।
শ্রোতাদের একজন মন্তব্য করেন, ‘রাহাতের গল্প শুনে মনে হয়েছে, প্রতিটি মানুষই পারে সমাজ বদলাতে- শুধু ইচ্ছাশক্তি আর নিষ্ঠা থাকতে হয়।’
অনুষ্ঠানের শেষে ঘোষণা করা হয়, নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নিতে নোলক ফাউন্ডেশন এবং কুইন্স লাইব্রেরি যৌথভাবে মাসিক ওয়ার্কশপ ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করবে। এর মাধ্যমে তরুণ নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এবং সামাজিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
‘জীবনের শেষ মুহূর্তে আমরা কী নিয়ে যাব? শুধু ভালো কাজের স্মৃতি,’ -রাহাত হোসেইনের এই বক্তব্য যেন অনুষ্ঠানের মূল মন্ত্র হয়ে ধ্বনিত হয়। নারী-পুরুষের সমতা এবং মানবতার জয়গান গেয়ে এই আয়োজন কুইন্সের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে রইল।
রাজীয়া নাজমী তাঁর সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘রাহাত হোসেইনের মতো নেতৃত্বই প্রমাণ করে, নারীরা শুধু স্বপ্ন দেখেন না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও তৈরি করেন।’
অনুষ্ঠানের প্রশ্ন উত্তর পর্বের আলোচনায় যোগ দেন সাংবাদিক সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, ইব্রাহীম চৌধুরী, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা পরিবারের ফরিদা ইয়াসমিন, সোহানা নাজনীন, নারী সংগঠক রোকেয়া আক্তার প্রমুখ।