কুমিল্লা: ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের জেলা কুমিল্লা। গেল কয়েক দিনে কুমিল্লার জেলার কিছু এলাকা বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে বেশকিছু এলাকা। এরমেধ্যে জেলার ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, নাঙ্গলকোট, লাকসাম মনোহরগঞ্জ ও বরুড়া উপজেলায় বেড়েছে বন্যার পানি।
এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলাতেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে আচমকা এ বন্যা। উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গোমতীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এক সেন্টিমিটার কমলে ফের এক সেন্টিমিটার বেড়ে যায়।
এ দিকে, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সীমান্তবর্তী ইউনিয়নের শশীদল সালদা নদীর বেড়িবাঁধও ভেঙে প্লাবিত হয় ব্রাহ্মণপাড়া। দুই নদীর ভাঙনে এ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭০ হাজার পরিবার। পানিবন্দি পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে আটটি উদ্ধার দলসহ স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। আচানক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার তিতাস উপজেলার মানুষ একটু আশ্রয়ের জন্য চারদিকে ছুটাছুটি করছে। রাস্তা ঘাট ও ঘর বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে তিতাস উপজেলার হাজার হাজার মানুষ একটু আশ্রয়ের জন্য আত্মীয়-স্বজন, উচু ভবন কিংবা স্কুল, কলেজ আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
জেলার নতুন করে বন্যার পানি প্লাবিত হয়েছে দেবিদ্বার উপজেলায়। উপজেলার প্রশাসন জানায়, দেবিদ্বারের সুবিল ইউনিয়নের বুড়িরপাড় এলাকার গ্রামগুলোতে বন্যার ব্যাপক পানিতে ডুবিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি।
অন্য দিকে, জেলার দক্ষিণাঞ্চলের মনোহরগঞ্জ, বরুড়া, লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলায়ও গতকাল সোমবার (২৬ আগস্ট) আরো বেড়েছে বন্যার পানি। এসব এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন ছুটছেন অন্যস্থানে। অনেকে আশয়কেন্দ্রে নিরাপদে যাচ্ছেন।
চৌদ্দগ্রামের গুণবতী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল জানান, বন্যায় সব গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে পুরো উপজেলায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা পরিষদ এলাকায় পানি ঢুকায় নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। তবে, উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠে কাজ করছে। এ দিকে, নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, ঢালুয়া ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি বেশি খারাপ। এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষই পানিবন্দি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘গেল কয়েক দিন থেকে গোমতির পানি কমেছে। তবে, গোমতীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি না কমলে বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। পানি না কমা পর্যন্ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতেই থাকবে।’
বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে যোগাযোগ করলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলি জানিয়েছেন, কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ১১৮টি ইউনিয়নের অধিবাসী। আমরা বন্যার্তদের মাঝে প্রতিদিন ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছি।’
কুমিল্লার জেলার প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘জেলার ১৪টি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলায় নয় লাখ ৫১ হাজার ১০৯ জন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। আর আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন ৬৬ হাজার ৯৬৬ জন। জেলার বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাদ্য, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে।’
এ দিকে, পানিবন্দি পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে উদ্ধার দলসহ স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। পর্যাপ্ত নৌকা সংকটের কারণে ঢাকা থেকে ড্রাম এনে ভেলা তৈরি করে উদ্ধার কাজ চলমান রাখা হয়েছে কিছু জায়গায়। আশ্রয় কেন্দ্রে আনা বন্যার্তসহ বন্যাদুর্গতদের দেয়া হচ্ছে শুকনো খাদ্য ও নিরাপদ পানি। তবে, এটি চাহিদার তুলনায় সামান্য। এ জন্য মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্ট বেড়েই চলেছে। দেখা দিয়েছে তীব্র বিশুদ্ধ পানির সংকট।
এ দিকে, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি, সেচ্ছাসবী সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়। নৌকা দিয়ে ত্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে।
পাবনা থেকে ট্রাকে ত্রাণ নিয়ে কুমিল্লায় এসেছেন সুজন আহম্মেদ রনি জানান, পানির গভীরতায় নৌকা বা স্প্রীড বোর্ড প্রয়োজন। এখানে নৌকা কোন ব্যবস্থা নেই। তাই, প্রত্যান্ত অঞ্চলের বনভাসীদের ত্রাণ দিতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ডাঙ্গায় যারা তাবুতে ছিল তাদের ত্রাণ দিয়ে চলে আসতে হল।
এছাড়াও, কুমিল্লায় বন্যাদুর্গদের মাঝে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক ও বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক আমিনুর রশীদ ইয়াছিনের নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও প্রাক্তন সাংসদ সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।