বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

কুরস্কের যুদ্ধে ইউক্রেনের সৈন্যরা ক্লান্ত, ট্রাম্পের অপেক্ষায় তারা

বুধবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

কুরস্ক, ইউক্রেন: হতাশার সুর যেন বিরাজ করছে চারপাশে। ‘পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা এর শেষ দেখতে পাচ্ছি না।’ রাশিয়ার সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধ করা ইউক্রেনের এক সৈন্য এ কথা বলেন। সংবাদ বিবিসির।

প্রায় চার মাস আগে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইউক্রেইন। তারা কুরস্কের একটা অংশ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে কুরস্কে কর্মরত বেশ কয়েকজন ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে টেলিগ্রামের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। তাদের একজন অবশ্য সম্প্রতি কুরস্ক থেকে দেশে চলে গেছেন। তবে, ইউক্রেনেরা সেনারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

সেনারা অঞ্চলটিতে বিরাজমান ভয়ানক প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন পরিস্থিতির পাশাপাশি এখন যোগ হয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়া।’

এখন শীতের সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে তাদের। তারা বলেন, ‘ইউক্রেইনীয় সেনাদের হঠাতে রাশিয়া কুরস্কে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ চলছে।’ ইউক্রেনেরা সেনারা বলেন, ‘রাশিয়া ভয়ংকর তিন হাজার কেজির গ্লাইড বোমাও ব্যবহার করছে কুরস্কে।’

রাশিয়ার বাহিনী ধীরে ধীরে এলাকা পুনর্দখল করায় তারাও পিছু হটছে বলে জানিয়েছে তারা। রাশিয়ার ক্রমাগত বোমাবর্ষণের কারণে ইউক্রেনেরা সেনারা ঘুমাতে পর্যন্ত পারছেন না। রাশিয়ার বাহিনীর হামলার মুখে ইউক্রেনেয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানায় তারা।

তারা বলেন, ‘রাশিয়ার বাহিনী ধীরে ধীরে ইউক্রেনের সেনাদের দখল করা অঞ্চল পুনরুদ্ধার করছে।’ গেল ২৬ নভেম্বর পাভলো (ছদ্মনাম) নামের ইউক্রেনেরা সেনা জানিয়েছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি ধারণা করছেন। এমনকি ইউক্রেনের সেনাদের কুরস্কের দখল করা এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারানো সময়ের ব্যাপারমাত্র।

ইউক্রেনেরা সেনারা বর্তমানে ঠিক কতটা ক্লান্তিকর পরিস্থিতি পার করছে, সেই কথাই জানান পাভলো।

পাভলো জানিয়েছেন, নতুন যে সেনা ইউনিট ইউক্রেইন কুরস্কে মোতায়েন করছে, তা মূলত মধ্যবয়সী পুরুষদের দল। এ দলগুলো অন্য কোন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি কুরস্কে পাঠানো হয়েছে। এর ফলে, ইউক্রেনেরা সেনাদের বিশ্রামের সুযোগ নেই।

পাভলো নামের এক সেনা সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।

সেনাদের অভিযোগ, তাদের কমান্ডিং অফিসার, আদেশ ও সরঞ্জামের অভাব। এটা আসলে খুব অস্বাভাবিক কিছু না। কঠিন পরিস্থিতিতে সেনারা প্রায়ই এমন হতাশায় ভুগে থাকেন।

ইউক্রেনেরা সেনাদের নানা অভিযোগের কথাও তুলে ধরেছে। কমান্ডিং অফিসার, তাদের আদেশ, যুদ্ধ সরঞ্জামসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভাব নিয়ে তারা অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু, এসব অভাব-অভিযোগের কথা শোনা হচ্ছে না বলে জানান ইউক্রেনের সেনারা।

ইউক্রেনেরা সেনারা বলেন, ‘তারা খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। অন্য দিকে, সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা আছে, তাও মনে হচ্ছে না।’

ইউক্রেনের সেনারা বেশিভারভাগই হতাশায় ভুগছে। তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেইনীয় সেনাদের মধ্যে প্রেরণার অভাব থাকার বিষয়টিও উঠে এসেছে তাদের কথায়।

ইউক্রেনের পূর্ব ফ্রন্ট থেকে রাশিয়ার সেনাদের সরিয়ে আনা এ অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোর একটি। কিন্তু, এ পরিকল্পনা কাজ করছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

ইউক্রেনেরা সেনারা বলছেন, ‘এখন কিয়েভের নির্দেশ হল, রাশিয়ার ভূখণ্ডের এই ছোট অংশটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে না আসা পর্যন্ত রাশিয়ার ভূখণ্ডের এই ছোট্ট অংশের দখল ধরে রাখার নির্দেশ রয়েছে।’

ইউক্রেনের সেনা পাভলো বলেন, ‘ট্রাম্পের অভিষেক ও আলোচনা শুরুর আগ পর্যন্ত আমাদের সামনে প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সর্বোচ্চ অঞ্চল ধরে রাখা। যাতে পরে কোন কিছুর বিনিময়ে অঞ্চলটি দর কষাকষিতে কাজে আসে। কিন্তু কেউ জানে না, সেটা কী।’

গেল নভেম্বরের শেষের দিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ইঙ্গিত অনুযায়ী উভয় পক্ষই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেছে। পাভলো বলেন, ‘আমি নিশ্চিত তিনি (পুতিন) আমাদের (ইউক্রেন সেনা) ২০ জানুয়ারির মধ্যে কুরস্ক থেকে বিতাড়িত করতে চান। এটি প্রমাণ করা তার (পুতিন) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন। কিন্তু, তিনি আদতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।’

কুরস্কে রাশিয়ার পাল্টা হামলা ঠেকাতে ইউক্রেনকে সহায়তা করার প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স কিয়েভকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে লক্ষ্যবস্তুতে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

অন্য দিকে, ইউক্রেন এরই মধ্যে গেল আগস্টে কুরস্কে দখল করা প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা হারিয়েছে। ভাদিম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘মূল লক্ষ্য দখল করা নয়। বরং, ধরে রাখা এবং আমরা এটি নিয়ে লড়াই করছি।’ ক্ষয়ক্ষতি হলেও ভাদিম মনে করেন, কুরস্ক অভিযান এখনও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে কিছু রাশিয়ার বাহিনীকে জাপোরিজিয়া ও খারকিভ থেকে সরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘তবে, আমরা যেসব সেনার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কয়েকজন বলেছেন, তারা মনে করছেন, তারা ভুল জায়গায় আছেন, রাশিয়ার কিছু অংশ দখল করার চেয়ে ইউক্রেইনের পূর্ব ফ্রন্টে থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণে যোগ দিতে কুরস্কে উত্তর কোরিয়ার প্রায় দশ হাজার সেনা পাঠানো হয়েছে বলে কয়েক সপ্তাহ ধরে খবর পাওয়ার পরও আমরা যে সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারা এখনও তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত নয়।

‘আমি জীবিত বা মৃত কোরিয়ানদের সম্পর্কে কিছুই দেখিনি বা শুনিনি।’ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন ভাদিম। তবে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী উত্তর কোরিয়ার রেডিও যোগাযোগের রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, ‘এত কষ্টের মধ্যেও কুরস্ক অভিযান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা কেন্দ্রের কর্মকর্তা সেরহি কুজান বলেন, ‘এটিই একমাত্র এলাকা, যেখানে আমরা এই উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছি।’

তিনি স্বীকার করেছেন যে, ইউক্রেনের বাহিনী কুরস্কে ‘অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া তাদেরকে হটানোর জন্য প্রচুর সম্পদ ব্যয় করছে।’

তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, আর্টিলারি, হিমারস ও অবশ্যই দূরপাল্লার অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আমরা এই কুরস্ক ফ্রন্টকে যত বেশি সময় ধরে রাখতে পারব ততই মঙ্গল।’