শাহীন চৌধুরী: শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব ছিলেন একজন নান্দনিক কন্ঠ শিল্পী ও গানের সাধক। চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত গানকে তিনি একটি আলাদা মাত্রা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। গান যে কেবল শোনার নয়, এটিকে মানুষের মনে রাখার মত একটা অবস্থান তিনি তৈরি করেছেন। তার উপস্থাপনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ও নান্দনিক। তিনি গান গাওয়ার সময় তার রসটাকে বুঝতেন ও সেভাবে নিজস্ব ঢঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করতেন। যার ফলে, গানের ভাব ও বিষয় মানুষের খুব সহজ হয়ে যেত। তাই, চট্টগ্রামের গান বলতে শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চবের নামটায় আগে আসে। তার গায়কী বহু গীতিকারকে গান লেখায় অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করত।
শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণরেব জন্ম ১৯২৭ সালের ১৫ জুন। নন্দীর হাটের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। বাবা জয়দাশ ছিলেন আধ্যাত্মিক গানের সাধক। মুলত বাবার হাত ধরে তার গানে আসা। ছোটবেলায় নানা কৌতুক মিশ্রণে গান গাওয়া তার স্বভাবজাত অভ্যাস ছিল বিধায় পরবর্তী তাকে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে জীবিকার তাগিদে তাকে নামতে হয়। ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ বেতারে ‘গুরা বউ বউরে’ এ গানটি গেয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে শেফালী ঘোষের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তাদের জুটি কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে জনপ্রিয়তা তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারা আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সমাজ্ঞী হিসেবে আজও মানুষের মনিকোটায় বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ বেতারে এ জুটির প্রথম গান ‘নাউয়ুর গেলে বাপর বাড়ি, আইস্যু তাড়াতাড়ি’। দুইজনে প্রায় ২৯টি দেশে গান গেয়েছেন।
শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘরে বসে থাকেননি, আকাশবাণীতে গান গেয়ে যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি নানাজনের গান গেয়েছেন; তাদের মধ্যে এমএন আকতার, আবদুল গফুর হালী, সৈয়দ মহিউদ্দিন অন্যতম। চলচ্চিত্রেও বহু গান গেয়েছেন। সৈয়দ মহিউদ্দিন ছিলেন একেবারে তার পরিবারের একজন সদস্যের মত। যে কারণে অসংখ্য জনপ্রিয় গান তারা সৃষ্টি করেছেন। চট্টগ্রামের প্রকৃত আঞ্চলিক ঢং ও ভাষার ব্যবহার সৈয়দ মহিউদ্দিনের গানে প্রাধান্য পেত। শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব নিজেও বহু গান রচনা ও সুর করেছেন। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে তোঁয়াত্তে ক্যান লার, আঁরে হত ভাড়াইবা, বিয়ার পর নিয়ুম তোঁয়ারে, আঁর বাইক্কা টেঁয়া দে, আঁর বউরে আঁই কিলাইয়ুম, ও জেডা ফইরার বাপ, চল আঁরা ধাই, বানুরে জ্বি –, দেশে গেলে কইয়েনগো ভাইজান, আঙ্গো বাড়ি নোয়াখালীসহ এ রকম বহু গান।
তার পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। জীবদ্দশায় এ গুণী শিল্পী রাষ্ট্রের কোন পদক পাননি। এমনিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন তাকে পদক দিয়ে সন্মানিত করেছেন। মৃত্যুর আট বছর পর ২০০৮ সালে তিনি রাষ্ট্রেীয় একুশে পদকে পেয়েছিলেন। বেঁচে থাকতে এমন কোন পদককে তিনি তুচ্ছ করে গানকে উচ্চমাত্রায় নেয়ার ক্ষেত্রে সাধনা করে গেছেন। সরল ও সাদামাটা জীবনে গানই তার আত্মার খোরাক ছিল। যত দিন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকবে, তত দিন শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। দুঃখ হয় আমাদের চট্টগ্রামে একটা টেলিভিশন কেন্দ্র আছে! কিন্তু, বহু জনের ছবি টাঙানো থাকলেও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের ছবি স্থান পায়নি। এ টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রিকতা আমাদের ব্যথিত করে।
এ গুণী সুর, গানের সম্রাট দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু, কারো কাছে সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকার করুণা চাননি। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে যান। আজ ৪ ডিসেম্বর তার ২৪তম মৃত্য বার্ষিকীতে জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে।
লেখক: অভিনেতা, নাট্যকর্মী, চট্টগ্রাম।