শাহরিয়ার হান্নান: আমার থিয়েটার করা শুরু নাট্য সম্প্রদায় শিকড়’র মাধ্যমে আমার স্কুল শিক্ষক অসিত দাশ পুলকের হাত ধরে ১৯৯২ সালে। শিকড় তত দিনে প্রতিষ্ঠার চার বছর পার করেছে। সেখানেই আহাম্মদ কবীর ভাইয়ের সাথে পরিচয়। সংগঠনটি তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। টেক্সটাইল মিলে চাকরি ও শ্রমিক রাজনীতি তার পেশা হলেও শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তার পড়াশোনা ও ধ্যান ধারণা আশ্চর্য করেছিল। শ্রমিক নেতাদের সম্পর্কে ধারণা ছিল, তারা হয়তো রাজনীতি করে নিজের আখেরটা গুছিয়ে ফেলেন। কিন্তু, ছোটখাটো কাল মানুষটির সাথে যখনই দেখা হয়েছে, তিনি কোন না কোন শ্রমিক সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। হোক সেটা কারখানা সংশ্লিষ্ট বা শ্রমিকের পারিবারিক। শ্রমিক সংগঠনের নীতি নির্ধারনী বিষয়গুলোতে কবীর ভাই ছিলেন অপরিহার্য। গঠনতন্ত্র, দাবীনামা, প্রতিবাদ লিপি, শ্রমিকদের জীবন বৃত্তান্ত, ছুটির দরখাস্ত যাই হোক কেন, তার জন্য কবীর ভাইয়ের কাছে সবাই ছুটে আসত। এসব সামাল দিয়েও তিনি ঠিক মহড়ায় উপস্থিত হয়ে যেতেন।
শিকড়’র মহড়া হত মীর্জা আহমেদ ইস্পাহানি স্কুলে। তার হাত ধরে পাহাড়তলী এলাকার অনেক যুবক শিকড়’র সাথে যুক্ত হয়। তার কারখানার অনেক শ্রমিক চাকরির পাশাপাশি নাট্য চর্চার সাথে যুক্ত হয়েছিল। কেন্দ্র হতে দূরে মফস্বলের সংগঠন শিকড় মেঠো অনুষ্ঠানই বেশি করত। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মাঠে মঞ্চ তৈরি করে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। অনুষ্ঠান আয়োজনের খরচ সংগ্রহের জন্য গণ চাঁদা ছিল প্রধান উৎস। সংগঠনের সদস্যরা তার নেতৃত্বে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করত। শিকড়ে অসিত দাশের নির্দেশনায় আহাম্মদ কবীরের ‘যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ নয়’ মঞ্চায়ন করে ১৯৯৪ সালে। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার বেদনা যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন তুলে ধরা হয়েছ। পাহাড়তলী এলাকার বিভিন্ন স্থানে নাটকটির একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। নাটকটির সহজ সরল সংলাপ ও গঠনশৈলীর কারণে দর্শককে সম্পৃক্ত করতে পারতো। নাটকটির যুদ্ধাপরাধী চরিত্রটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, কোন কোন স্থানে দর্শক তাকে প্রতিরোধের জন্য আক্রমণ করে বসে। শিকড় মোস্তফা কামাল যাত্রার নির্দেশনায ‘দ্বীপ’ (উৎপল দত্ত) ও শাহরিয়ার হান্নানের নির্দশনায় ‘মেশিন’ (সফদর হাশমী) মঞ্চায়ন করলে আহাম্মদ কবীর তা সম্পাদনা করেন। দ্বীপ নাটকটি ভারতীয় পটভূমিতে লেখা হলেও তিনি নাটকটি আমাদের দেশের খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনার আলোকে এমনভাবে সম্পাদনা করেন যে, তখন তা বাংলাদেশের বয়ান হয়ে উঠে। মেশিন নাটকটিও ভারতের শ্রমিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হলেও তিনি একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রমিকদের যে চিত্র দেখেছেন, তার আলোকে সম্পাদনা করেছেন। যার কারণে নাটকগুলো অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
আহাম্মদ কবীর শুধুমাত্র নাটকের সংগঠনই সংগঠিত করেননি, তিনি পাহাড়তলী এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন সুতরাং শিল্পী গোষ্ঠী, সারগাম সংগীত পরিষদ এবং আবৃত্তি সংগঠন নন্দন আবৃত্তি চক্র সংগঠিত করেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সুসংগঠিত করবার জন্য ১৯৯৯ সাসালে পাহাড়তলী এলাকার সক্রিয় সংগঠনগুলো নিয়ে গঠন করেন ‘পাহাড়তলী সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’। যার মাধ্যমে কেন্দ্র হতে দূরে পাহাড়তলী এলাকায় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার শুরু হয়। এসব সংগঠনের একাধিক শিল্পী বৃহত্তর গন্ডিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশ্যাল এ্যাকশন (উৎস) তাকে কেন্দ্র করে ‘শ্রম ইউনিট’ প্রতিষ্ঠা করলে তিনি সেখানে শ্রমিকদের সংগঠিত করে শ্রমিক সমস্যা সংশ্লিষ্ট নাটক রচনা করেন। অসিত দাশ সভা আঙ্গিকে তার ‘অবরোধ’ নাটকটি নির্দেশনা দেন। নাটকটির বেশিরভাগ কলাকুশলী ছিল স্থানীয় শ্রমিক।। নাটকটিতে শ্রমিকদের শোষণ, বঞ্চনা, দাবী দাওয়া এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, নাটকটির শ্লোগানের সাথে দর্শকরাও শ্লাগান ধরতেন।
আহাম্মদ কবীর বাম রাজনীতি করলেও তার সংগঠনর গনতন্ত্র চর্চা করতেন। তার মাধ্যমে অনেক কর্মী ও নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। তিনি তার মতামত কখনই চাপিয়ে দেননি। তার জীবনের শেষ দিকে তিনি মোস্তফা কামাল যাত্রার মাধ্যমে নাট্যাধার’র সাথে যুক্ত হন। যেখানে তার রচিত ফুলজান, ধানমন্ডি ৩২ মঞ্চস্থ হয় ও আলোচিত হয়। আহাম্মদ কবীর কবীর এস্টাবলিশমেন্টের পেছনে দৌঁড়াননি। নতুবা তিনি যে সময় সংস্কৃতি চর্চা ও লেখালেখি শুরু করেন, তা যদি যথাযথ প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করা যেত, তবে তা জাতীয়ভাবে মূল্যায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। একইভাবে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হলেও নিজের স্বার্থে তিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেননি। তার নাটকের চরিত্র সোলেমান বাদশার মতই তিনি তার চাকরি শেষে ছেলেমেয়েদের এ করকম অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে ফিরে যান তার সুচক্রদন্ডি গ্রামে।
আহাম্মদ কবীরের সাহিত্য কর্মের খুব অল্প অংশই প্রকাশিত হয়েছে। যে কারণে একজন আহাম্মদ কবীর যথাযথভাবে মূল্যায়িত হননি। এখনো তার সৃষ্টিগুলো যদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হয়, তবে আমাদের নাট্য সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে এবং এ জনমানুষের রাজনীতি সচেতন শিল্প অন্তপ্রাণ মানুষটির প্নতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
লেখক: নাট্যজন, চট্টগ্রাম