শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাড়িকে মশামুক্ত রাখার উপায়

বৃহস্পতিবার, জুলাই ২৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

লাইফস্টাইল প্রতিবেদক: বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে গ্রাম ও শহর সব পরিবেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাসায়নিক প্রতিরোধে দ্রুত সমাধান মিললেও অনেকেই খুঁজছেন তার নিজ বাড়িকে মশা মুক্ত রাখার প্রাকৃতিক উপায়। রোগ-জীবাণু বহনকারী মশা থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু ব্যবহারিক কৌশল জানা প্রয়োজন। আপনার আশ্রয়টিকে মশামুক্ত রাখার জন্য এমন কিছু উপায় জেনে নেয়া যাক, যেখানে আপনার স্বাস্থ্য ও চারপাশের পরিবেশ দুই-ই ভাল থাকবে।

জমে থাকা পানি ফেলে দেয়া: মশা যে কোন স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জমে থাকা স্থির পানিতে বংশবিস্তার করে। তাই, আপনার বাড়ির চারপাশে উন্মুক্তভাবে জমে থাকা পানির উৎসগুলো নির্মূল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য ফুলের পাত্র, পোষ্য প্রাণির ঘরে থাকা পাত্রের মত যাবতীয় পানির পাত্রগুলো নিয়মিত খালি ও পরিষ্কার করতে হবে। এখানে, বিশেষ নজর দিতে হবে নর্দমার দিকে, যেন মশা ডিম পাড়তে না পারে। পুকুর বা ফেলে দেয়া জিনিসগুলোতে জমে থাকা খুব অল্প পরিমাণ পানিও মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। মশার ডিম বা ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শ রোধ করার জন্য জমে থাকা পানি অপসারণের সময় প্রতিরক্ষামূলক পোশাক ও গ্লাভস পরুন; স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় পা পিছলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই, সম্ভাব্য মশার প্রজনন স্থান, বিশেষ করে নর্দমার মত জায়গাগুলো থেকে পানি সরানোর সময় সতর্ক থাকুন।

মশা প্রতিরোধকারী ফ্যান ও আলোর ব্যবহার: মশা তাড়ানোর এক্সস্ট ফ্যানের শক্তিশালী বাতাস মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়কে বাড়ির কাছাকাছি উড়তে দেয় না। বায়ু প্রবাহের এ প্রতিরক্ষামূলক বেস্টনীটি বাড়ির বাইরে কাছাকাছি এলাকায় কৌশলে স্থাপন করুন। পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় ব্যবহৃত আলোতে হলুদ বা এলইডি লাইট ব্যবহার করা মশা তাড়ানোর কার্যকারিতা আরো বাড়িয়ে দিবে। এ ধরনের আলো মশার কাছে কম আকর্ষণীয়। বাড়ির আশেপাশে যে জায়গায় মশা বেশি জড়ো হয়, সে স্থানগুলোতে এ আলো স্থাপন করুন। ফ্যানগুলো এমন জায়গায় স্থাপন করুন, যেন তা আপনার ও পরিবারের মানুষদের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকির কারণ না হয়; লাইটগুলো মশা তাড়ানোর পাশাপাশি বাড়ির বাইরের নির্দিষ্ট এলাকায় আলো দিতেও কাজে লাগে। তাই, এগুলোর ভাল মানের হওয়া উচিত। তাছাড়া, কোন ত্রুটি দেখা দিলে মেরামতের জন্য আপনার সহজসাধ্য হয়, তা নিশ্চিত করুন। এ ধরনের ফ্যান ও লাইট উভয়ের ক্ষেত্রে দক্ষ টেকনিশিয়ানের সাহায্য নেয়া উত্তম।

জানালায় পর্দা টাঙানো: মশাকে বাড়ির বাইরে রাখার জন্য জানালার পর্দা টাঙানো যেতে পারে। জানালা ও দরজাতে যেন কোন রকম গর্ত বা ফাঁক না থাকে। মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়কে বাইরে রাখার জন্য নেট সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে। কেননা, এটি ঘরের ভেতর তাজা বাতাস চলাচল করতে দেয়। সন্ধ্যায় ও ভোর বেলা যখন মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি থাকে, তখন জানালাগুলোর পর্দা টেনে দিলে ভাল কাজ দিতে পারে। নিয়মিত জানালার পর্দাগুলোর যত্ন নিন। অল্প ছেঁড়া বা গর্ত থাকলেও তা দ্রুত ঠিক করুন; বাতাস চলাচলে বাধাগ্রস্ত করতে পারে- এমন ধুলো অপসারণ করতে নিয়মিত পর্দা পরিষ্কার করুন।

জানালা ও দরজায় মশা প্রতিরোধী নেট ব্যবহার: এটি আপনার ঘর থেকে মশা দূরে রাখার একটি কার্যকর প্রাকৃতিক পদ্ধতি। নেটের সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো শুধু মশার জন্য প্রতিবন্ধকতাই তৈরি করে না, ঘরের ভেতর তাজা হাওয়াও ঢুকতে বাধার কারণ হয় না। টেকসই নেটটি সঠিকভাবে স্থাপন করা হলে এর কার্যকারিতা থেকে সর্বোচ্চ উপকারিতা পাওয়া যাবে। নেটের কোন ছিদ্র অতিরিক্ত বড় হয়ে যাচ্ছে কি না বা স্থাপনে কোন অসঙ্গতি আছে কি না তা ভালভাবে যাচাই করুন। কোন গর্ত বা অসঙ্গতি চোখে পড়লে অবিলম্বে তা মেরামত করুন। প্রয়োজনে পুরো নেটটি প্রতিস্থাপন করে নিন। নেট ব্যবহারের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে টানাটানি করা থেকে বিরত থাকুন। সঠিকভাবে স্থাপন করা হলে কোন বাধা ছাড়াই নেটকে ফ্রেমের ভেতর ডানে-বামে সরানো যাবে।

সন্ধ্যা ও ভোরবেলায় দরজা-জানালা বন্ধ রাখা: বাড়িতে মশার প্রবেশ কমাতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন, বিশেষ করে মশার উপদ্রবের সময়। সন্ধ্যায় ও ভোরের দিকে মশাসহ সব পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। এ সময় ঘরের ভেতরের গুমোট পরিবেশ আরামদায়ক রাখতে সিলিং ফ্যান ছেড়ে রাখুন। সব দরজা ও জানালা ঠিকমত বন্ধ হয়েছে কি না, কোন ফাঁক আছে কি না তা ভালভাবে দেখে নিন; মশা প্রবেশে অতিরিক্ত বাধা হিসেবে জানালা ও দরজায় পর্দা ব্যবহার করুন।

বাড়িতে মশা প্রতিরোধী গাছ রাখা: কিছু গাছপালা তাদের মশা প্রতিরোধক বৈশিষ্ট্যের জন্য সুপরিচিত। সেগুলো আপনার বাগানে রাখতে পারেন অথবা আপনার বারান্দায়ও টবে লাগাতে পারেন। এ গাছপালা এক ধরনের প্রাকৃতিক সুগন্ধি ছড়ায়, যা মশা তাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সিট্রোনেলা ও ল্যাভেন্ডারের কথা। এছাড়াও, রয়েছে বেসিল, পুদিনা, রোজমেরি ও গাঁদা। এ উদ্ভিদগুলো আপনার আঙ্গিনায় শুধু মশাই তাড়াবে না, দারুণ উপভোগ্য পরিবেশও তৈরি করবে। এক্ষেত্রে, গাছগুলোর বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত পরিচর্যা প্রয়োজন; গাছগুলো লাগানোর আগে সেগুলোর কোনটির প্রতি আপনার বা আপনার পরিবারের সদস্যদের অ্যালার্জি আছে কি না তা যাচাই করুন।

সিট্রোনেলা মোমবাতি বা তেল ব্যবহার করা: সিট্রোনেলা লেমনগ্রাস উদ্ভিদ থেকে পাওয়া একটি প্রাকৃতিক পোকামাকড় প্রতিরোধক। সিট্রোনেলা মোমবাতি জ্বালালে বা সিট্রোনেলা তেল ব্যবহারে আপনার বাড়ির ভেতরের ও বাইরের চারপাশের এলাকা নিশ্চিতভাবে মশামুক্ত থাকবে। এর শক্তিশালী ঘ্রাণ মশাকে আকৃষ্ট করা কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ল্যাকটিক অ্যাসিডকে ঢেকে দেয়। বাড়ির আঙ্গিনায় কৌশলে মোমবাতি রেখে বা ডিফিউজারে সিট্রোনেলা তেল ব্যবহার করে কার্যকরভাবে মশা তাড়ানো যেতে পারে। সিট্রোনেলা মোমবাতি বা তেল নিরাপদে ব্যবহারের জন্য সর্বদা মোড়কে দেয়া প্রস্তুতকারকের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন; যে কোন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য মোমবাতি বা তেল শিশু ও পোষা প্রাণীদের নাগালের বাইরে রাখুন।

বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখা: মশার বংশ নির্বংশ করতে বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করা অতি জরুরি। শুধু জমে থাকা স্থির পানিই নয়, অন্যান্য ধুলাবালি, ময়লা, আগাছা, পোষা পশু-পাখির মল, অন্যান্য উদ্বৃত্ত নিয়মিত অপসারণ করুন। ঘরের ভেতরে শোকেস, ফার্নিচার ও ফুলদানির মত লুকানো জায়গায় জমে থাকা পানি ও ময়লা খুঁজে বের করে তা পরিষ্কার করুন। বাড়ি পরিষ্কারের সময় সম্ভাব্য জীবাণুযুক্ত স্থানগুলোর সাথে আপনার শরীরের উন্মুক্ত অংশগুলোর সরাসরি যোগাযোগ এড়াতে প্রতিরক্ষামূলক গ্লাভস পরুন; পানির পাত্রগুলো কার্যকরীভাবে জীবাণুমুক্ত করার জন্য উপযুক্ত ক্লিনিং এজেন্ট বা দ্রবণ ব্যবহার করুন।

ঘুমানোর সময় বিছানায় মশারি টাঙানো: মশারির মত প্রতিবন্ধকতাটি আপনার ঘুমানোর সময় সুরক্ষা দিতে পারে। বিছানায় মশারি ঝুলিয়ে রাখলে রাতের বেলা মশা ঘরে ঢুকলেও আপনার শরীর পর্যন্ত আসতে পারবে না। যেসব এলাকায় মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি, সেখানে মশারি টাঙানো আবশ্যক। মশারির ছিদ্রগুলোর মাঝে বড় গর্ত আছে কি না তা আগেভাগেই দেখে রাখুন। কেননা ঘুমন্ত অবস্থায় মশার রক্ত খাওয়া ঠেকানোর কোন সুযোগ থাকবে না। অতঃপর, আপনার শরীরে মশাবাহিত রোগ-জীবাণু প্রবেশেও তখন বাধা দেয়ার অবস্থা থাকবে না। মশারির বড় ছিদ্র চোখে পড়ার সাথে সাথেই অবিলম্বে তা মেরামত করুন; মশারি ব্যবহার করার সময় খেয়াল রাখুন কোথাও মশারি এলোমেলোভাবে বা জট পাকিয়ে আছে কি না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের জন্য কোন শ্বাসরোধের ঝুঁকি তৈরি করছে কি না সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিন।

মশা নিধনের বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহার করা: বৈদ্যুতিক ফাঁদ আলো, তাপ ও কখনো কখনো ছোট ফ্যান ব্যবহার করে মশাকে আকর্ষণ করে। মশা বা পোকামাকড় ফাঁদে পড়তেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় বা আটকা পড়ে যায়। এ ফাঁদগুলো বাড়ির ভেতরে মশার সংখ্যা কমাতে বেশ কার্যকর। এগুলোকে এমন জায়গায় রাখুন যেখানে সাধারণত মশা বেশি দেখা যায়। যেমন- জানালার কাছে বা ঘরের অন্ধকার কোণে। বৈদ্যুতিক মশার ফাঁদ নিরাপদ ব্যবহারের জন্য মোড়কে দেয়া প্রস্তুতকারকের নির্দেশাবলী পড়ুন ও অনুসরণ করুন; বৈদ্যুতিক বিপদ এড়াতে ভেজা জায়গা হতে ফাঁদগুলোকে দূরে রাখুন।

শেষ কথা: এখন আপনি আপনার বাড়িকে মশা মুক্ত করার প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন। আপনি এখন নিমিষেই আপনার বাড়ির ভেতর ও বাইরে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। তবে, যে বিষয়টি মনে রাখা জরুরি তা হচ্ছে- এ কাঙ্ক্ষিত আশ্রয় বজায় রাখতে হলে আপনাকে নিয়মিত এর যত্ন নিতে হবে। অর্থাৎ, এ কর্মতৎপরতাকে আপনার নৈমিত্তিক জীবনধারণের সাথে একীভূত করে তাতে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।