বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

দ্বিতীয় মেয়াদে কেমন হবে ট্রাম্প-ইরান সম্পর্ক?

সোমবার, ডিসেম্বর ২, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ডেস্ক প্রতিবেদন: ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৭-২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে তুমুল উত্তেজনা দেখেছে পৃথিবী। ট্রাম্পের আমলেই ইরানের এলিট কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে খুন করা হয়। শুধু তাই নয়, পাঁচ বিশ্বশক্তি ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের ওপর আরোপ করেন নিষেধাজ্ঞার খড়গ।

ফের সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায়। দ্বিতীয় মেয়াদে তাহলে কেমন হতে যাচ্ছে ট্রাম্প-ইরান সম্পর্ক? ফের কি নিষেধাজ্ঞার খেলায় মেতে উঠবেন ট্রাম্প? ইরানের সম্ভাব্য কৌশল কী হতে পারে?

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বনাম আগ্রাসী ইরান: পূর্বের মেয়াদে কেমন ছিল ট্রাম্পের ইরান নীতি? তা বিশ্লেষণ করলেই ইরানের আগ্রাসী হওয়ার কারণ বেরিয়ে আসবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইরানের বৈদেশিক নীতি বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের বহুপাক্ষিক কূটনীতি থেকে সরে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার চূড়ান্ত পরিণতি পাঁচ বিশ্বশক্তি ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনা।

২০১৮ সালের মে মাসে ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ নামের সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন ট্রাম্প। মূলত ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে ওই চুক্তি করা হয়। কিন্তু, ট্রাম্প চুক্তিটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ চুক্তি আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও আঞ্চলিক তৎপরতা বন্ধে পর্যাপ্ত চাপ দেয়া হয়নি।

এমন দোহাই দিয়েই চুক্তি থেকে সরে এসে ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপের অংশ হিসেবে পুনরায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ কৌশলের লক্ষ্য ইরানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া, তেল রফতানি কমানো ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা। মূলত এ নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করলেও ফের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে ইরান। সেইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের ছায়াযোদ্ধাদের শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধমূলক উদ্যোগ নিতে শুরু করে ইরান।

সোলাইমানি হত্যা ও ট্রাম্পের সমালোচিত কৌশল: সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বেশ কিছু সমালোচিত কর্মকাণ্ড রয়েছে; যা নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ সম্পর্কেও ইঙ্গিত দেয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরানের এলিট কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা।

কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সাহসের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বার্তা দেয়। ওই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্ররোচনার পাশাপাশি সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতীত কর্মকাণ্ড জানান দেয়, ফের ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় আকারে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘শুধু তাই, নয় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ভঙ্গি সম্ভবত আরও আক্রমণাত্মক হতে পারে। পারস্য উপসাগরে নৌসেনা মোতায়েন, অবাধ নৌচলাচল এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে যৌথ মহড়া অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন ট্রাম্প। আর এটা স্পষ্ট যে, ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ার মত জায়গায় ছায়াযোদ্ধাদের সঙ্গে নতুন করে যুদ্ধে মেতে উঠবে যুক্তরাষ্ট্রও।

নিষেধাজ্ঞার খেলা: ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কৌশলগত একটি হাতিয়ার ছিল। ইরানে যা মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। এই যেমন তেল রফতানি কমে যাওয়া, রিয়ালের মূল্য নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়া। সর্বোপরি অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফের তিনি ইরানের ওপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব, লেবাননে হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থন থেকে শুরু করে ইয়েমেনে হুতিদের সমর্থন, সব সময়ই বিতর্কের মূল বিষয়। পুনরায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এই গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়নে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ইরান। যা এ অঞ্চলে কৌশলগত সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে।

ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ছায়াযোদ্ধা: ট্রাম্পের ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা শুধু পারমাণবিক কার্যকলাপের জন্য নয় বরং ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও আঞ্চলিক কার্যকলাপের মোকাবিলায় আলোকপাত করা হয়েছে। এ দিকগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার আঞ্চলিক মিত্র উভয়ের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে চাপের মুখে ইরান তার প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন খাতে কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে। আর এটি নিঃসন্দেহে একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার মত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে, যেখানে ইরান প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখার বিকল্প পদ্ধতি খুঁজছে।

ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে অন্যতম বিকল্প। প্রক্সি নেটওয়ার্ক বলতে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। ট্রাম্পের আগের প্রশাসন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস এবং এর সহযোগীদের কাবু করতে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়। নতুন করে ট্রাম্প ফের একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে মনে করেন অনেকে।

ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া: ঐতিহাসিকভাবেই ইরানের সামরিক তত্ত্ব হল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, দ্রুত-আক্রমণ নৈপুণ্য, ড্রোন ও ছায়াযোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করা। ট্রাম্পের বিজয়ের পর, ইরান তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দ্বিগুণ শক্তিশালী করতে পারে। বাভার-৩৭৩’-এর মত আরও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারে দেশটির সরকার। সেইসঙ্গে ড্রোনের বহর আরো সম্প্রসারণে মনোযোগ দেবে ইরান।

রাজনৈতিকভাবে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় চীন ও রাশিয়ার মত বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে পারে। এ অংশীদার দেশগুলো আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ সামরিক মহড়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগীদেরও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।