রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

শিরোনাম

নব বর্ষ ১৪৩০ সবার জন্য হোক কল্যাণময়

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৩, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

মো. গনি মিয়া বাবুল: বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলা নব বর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাংলা নব বর্ষ, চৈত্রের শেষ বৈশাখের শুরু। এ শেষ চৈত্র আর পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে উৎসব আয়োজন, তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। বাঙালির নতুন বছরের প্রথম দিন। মোঘল সম্রাট আকবর তার শাসনামলে ফসলের খাজনা তোলার সুবিধার্থে বাংলা বছরের হিসাব শুরু করেন। সেই থেকে বাংলা নব বর্ষ বরণ শুরু হয়। পহেলা বৈশাখ ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সব সম্প্রদায়ের এক মিলনের স্মারক।

বাঙালি জাতি সারাটা বছর অধীর আগ্রহে এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। পহেলা বৈশাখ প্রকৃতির নিয়মে ঘুরে আসে। এ বছর বাংলা নব বর্ষ ১৪৩০ নানা আয়োজনে বরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজকরা ডিজিটাল মাধ্যমে বর্ষ বরণের উদ্যোগ নিয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিত সূর্যোদয় থেকে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের প্রভাতী সংগীতায়োজন করে আসছে ছায়ানট। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে রমনা বটমূলে অনুুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।

এ বছর রমনা বটমূলে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঢাকার রমনা বটমূলে নানা আয়োজনে বাংলা নব বর্ষ বরণ করা হবে। এছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দেশের সব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আয়োজনে বর্ষ বরণ করা হবে। নব বর্ষ উৎসবে নানা আয়োজন দেশ-বিদেশে মানুষের জীবনকে নানাভাবে উজ্জীবিত ও আন্দোলিত করে। উৎসব আয়োজনে থাকে বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, পুতুল নাচ, জারি-শাড়ি, গানের আসর, লাঠি খেলা, নানা রকম পিঠা-পুলির আয়োজন, অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন করা হয়। এসব আনুষ্ঠানিকতা বাঙালিতে বিশ্ব দরবারেও পরিচিত ও সমৃদ্ধ করেছে।

২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে জাতিসংঘের ইউনেস্কো গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে। সব জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করে একটা সুস্থ ও সচেতন মানস গঠনের দায়িত্ব নেয়। সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করেই মানুষ নিজের ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা যে কোন জাতিকে বড় হওয়ার প্রাথমিক দীক্ষা দেয়। বাঙালির জীবনে বাংলা নব বর্ষ একটি সচেতন প্রতিফলন। মূলত বাংলা নব বর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে। বাংলা নব বর্ষের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। সচেতন জাতির পরিচয় প্রকাশিত হয়, বিচিত্র সাংস্কৃতির রূপের মধ্য দিয়ে। বাংলা নব বর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সেই পরিচয়বাহী। নব বর্ষ মানুষকে সচেতন করে তার সাংস্কৃতিক চেতনার স্বপন্দনে। জাতীয় জীবনে বর্ষ বরণের প্রথম দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অর্থ নতুনকে বরণের সাগ্রহ মনোভাব। বাঙালি একটি ভাষাভিত্তিক জাতি। যাদের জন্ম বঙ্গে, মাতৃভাষা বাংলা, মূলত তারাই বাঙালি। এ বাঙালির বড় উৎসব বাংলা নব বর্ষ।

বিগত বছরের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, উৎসবের স্মৃতিচারণ পরিহার করে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। বৈশাখে উৎসবে মানুষের ঢল নামে। মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। নানা ধরনের হাতের তৈরি দ্রব্য ও খাবারের মেলা যেন গ্রামবাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবন যেন খন্ড খন্ড হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারু কাজে। মাটির পুতুল, পাটের শিখা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, পুঁতিমালা, কত না অদ্ভুত সব জিনিসের সমাবেশ ঘটে সে মেলায়। চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হয় না বাংলার মানুষের জীবন এত সমৃদ্ধশালী। বাংলার মানুষ গরীব হতে পারে, দারিদ্র্যের নিস্পেষণে তারা জর্জরিত হতে পারে। কিন্তু, এসব দুঃখ কষ্ট তাদের জীবনকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। নব বর্ষ বছরটির জন্যে আশার বাণী বহন করে নিয়ে আসে। তাই, নব বর্ষ আমাদের প্রাণে জাগায় আশার আলো ও উদ্দীপনা।

বাঙালি জীবনে যেমন ছিল পূণ্যাহ অনুষ্ঠান, তেমনি হালখাতা অনুষ্ঠান। জমিদারি প্রথা বাতিলের সাথে পূণ্যাহ অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু, হালখাতা অনুষ্ঠান সগৌরবে বিরাজমান। নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে উদযাপিত হয় হালখাতা উৎসব। বিগত বছরের ধার-দেনা শোধের পর্ব শুরু হয় এ দিনে। এর মধ্যে শুধু ব্যবসায়িক লেনদেন নয়, হৃদয়ের বিনিময়ও ঘটে। ব্যবসায়িক লেনদেনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যতা বাড়ে। আজকাল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে। শহরে শহরে মুক্তাঙ্গণে কবিতা পাঠ, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি কর্মসূচি পালিত হয়। ঢাকায় রমনার বটমূলে এ অনুষ্ঠান বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু নাচ-গানই নয়, বাঙালির বহুকালের অভ্যাস, পান্তা ভাত ও ইলিশ ভাজি খাওয়া এখানে চালু আছে বহু বছর থেকে। বৈশাখের তথা বাংলা নব বর্ষের চেতনা বাঙালির হৃদয়ে অন্তরে মিশে আছে। কিন্তু, পরিতাপের বিষয়, বাংলা নব বর্ষের ব্যবহারিক প্রয়োগ আমাদের জীবনে প্রায় অনুপস্থিত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা সন কিংবা বাংলা তারিখের ব্যবহার নেই বললেই চলে। বিদ্যালয়, অফিস, আদালত, ব্যাংক-বীমা, বিদেশ ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ ইত্যাদি কোন পর্যায়েই বাংলা তারিখ ব্যবহৃত হয় না। পৃথিবীর বুকে একমাত্র যে দেশের মানুষ তাদের ভাষা রক্ষার জন্যে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে, যে দেশে প্রতি বছর বাংলা নব বর্ষ পালিত হয় জমজমাট পরিবেশে, আনন্দঘন উৎসবে। সে দেশেই বাংলা সন ও বাংলা তারিখ উপেক্ষিত! এ অবস্থায় পহেলা বৈশাখের চেতনা তথা বাঙালির সংস্কৃতি ও বাংলা সন তারিখ আদালতসহ দেশের সর্বত্র চালু করা প্রয়োজন। সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাংলা তারিখ ব্যবহার করা অপরিহার্য।

নব বর্ষ নতুন নতুন বার্তা নিয়ে ফিরে আসে। পূর্বের ভুল-ভ্রান্তি, গ্লানি, পঙ্কিলতা, নানা অনাচার ধুয়ে-মুছে সুন্দর, সত্য ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে এবারের বৈশাখ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বাংলা নব বর্ষ ১৪৩০ সবার জন্যে হোক কল্যাণময়।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক, কলাম লেখক ও সংগঠক