আকতার কামাল চৌধুরী: বহু নাটকীয়তা, বহু কূটনীতি, বলতে গেলে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের রক্তের পিপাসা মিটে যাওয়ার পর গেল ২৫ মার্চ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে হামাস-ইসরায়েল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তির আহবান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে অন্যান্য দেশ পক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। এ ধরনের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকাও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার মতই। ইতিপূর্বে কয়েক বার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আনা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর মুখে সব ভেস্তে যায়। এ প্রস্তাবের অব্যাবহিত পূর্বে একই আদলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেও তা ভেটো দিয়ে আটকে দেয় চীন-রাশিয়া। হতে পারে, ইতোপূর্বে চীন-রাশিয়া সমর্থিত কয়েকটি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র বার বার ভেটো দেয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত এ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে তারা ঝাল মেঠায়।
জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদের যে কোন সিদ্ধান্ত মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোন পক্ষ মেনে না চললে প্রতিপক্ষের আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার থাকে। এমনকি, চাইলে নিরাপত্তা পরিষদ শক্তি প্রয়োগসহ ওই সদস্য রাষ্ট্রকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কারও করতে পারে। সেই বিবেচনায় সদ্য পাশ হওয়া এ প্রস্তাবে হামাসও কিছুটা আইনগত সুবিধা পাওয়ার কথা।
কিন্তু, বাস্তবতা হল – বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের এ প্রস্তাব ইসরায়েল কি আদৌ মেনে চলছে? এর উত্তরে বলতে হয় ‘না’ এবং ‘না’। ইসরায়েলের পক্ষে এ যুদ্ধ থামানোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং দুনিয়ার উদ্বেগ উপেক্ষা করে নতুন করে রাফায় আক্রমণের মধ্য দিয়ে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা শুরু করে।
আরো আশ্চর্য হল- নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবের আলোকে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া যখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে কাতারে মধ্যস্থতাকারীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন ঠিক ঈদের দিন-ই ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে তার তিন পুত্র, তিন নাতি-নাতনিকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের তিন জেনারেলসহ ১২ জনকে হত্যা করে বিশ্বে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেয় ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এ হত্যাকান্ডের নিন্দা করার গরজও বোধ করেনি। বরং এর জবাবে ইরান ইসরায়েলে যে ড্রোন-ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করে তা আকাশে ধ্বংস করে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তারা। এমনকি ইরানকে এ ‘পাপের শাস্তি’ দিতে না না নিষেধাজ্ঞার জালে আটকানোও শুরু করে।এভাবে ইসরায়েল বরং দিন দিন আরো বেপরোয়া, আরো সহিংস হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীই তার প্রমাণ।
পশ্চিমাদের একচোখা সমর্থনেই ইসরায়েল নিরাপত্তা পরিষদের এ সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর দু:সাহস দেখাচ্ছে। এ অমান্যতার কারণে জাতিসংঘ কি ইসরায়েলের উপর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বা নিতে পারবে? না, পারবে না। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আসছে ইসরায়েল। একের পর এক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলে নিতে কারো নিষেধ কিংবা আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করেনি এ রাষ্ট্র।
সত্যি বলতে কী, এ প্রস্তাব পাশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় কিছুটা অপ্রস্তুত ছিল ইসরায়েলের নেতৃত্ব। তারা ভেবে রেখেছিলেন, প্রতি বাবের মত যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবেও ভেটো দিয়ে তার চিরাচরিত মধ্যপ্রাচ্যে নীতির প্রকাশ ঘটাবে। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থেকে প্রকারান্তরে এ প্রস্তাব পাশে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। সংগত কারণেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চরম নাখোশ যুক্তরাষ্ট্রের উপর, বিশেষভাবে বাইডেনের উপর। ফলস্বরূপ ইসরায়েল পেন্টাগনের সাথে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করে।
এ প্রস্তাব পাশ হওয়ার ঠিক আগের সপ্তায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিক্সন মধ্যপ্রাচ্য এবং সর্বশেষ ইসরায়েল সফর করেন। এ সফরকালে আরব নেতৃবৃন্দ হামাস-ইসরায়েল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার গনহত্যা বন্ধ এবং রাফায় সামরিক অভিযানে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করেন। ব্লিঙ্কেনও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নেতানিয়াহুকে তুলে ধরেন। এমনকি কোন রাখঢাক না-রেখে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া এবং রাফা অভিযানে মারাত্মক পরিণতির বিষয়েও ইসরায়েলকে সতর্ক করেন। ব্লিঙ্কেনের এমন সতর্কবার্তায় নেতানিয়াহুকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি। এ-অবস্থায় কিছুটা টানাফোড়ন, উষ্মা ও অতৃপ্তি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ করেন এন্টনি ব্লিঙ্কেন। এর ঝাঁঝ কমতে না কমতেই মোজাম্বিক কর্তৃক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠে নিরাপত্তা পরিষদে। আর যুক্তরাষ্ট্রও তার ‘জমজ ভাই’ ইসরায়েলের একগুঁয়েমির এক অম্নমধুর জবাব দিয়ে দেয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো না দিয়ে।
সন্দেহ নেই- নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবের কারণে ইসরায়েল এখন চাপের সম্মুখীন, সেটা নিজ দেশে, জিম্মিদের স্বজনদের কাছে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও। এটি একটি শক্তিশালী প্রস্তাব। কারণ, পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকলেও অপর ১৪ সদস্য রাষ্ট্রই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। কেউ বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি। কিন্তু, সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের সমীকরণ বদলে দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রস্তাব না মানলে কী করতে পারবে জাতিসংঘ? তখন কোন সদস্য দেশ হয়তো আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনবে। কিন্তু দেখা যাবে – যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে নিন্দা প্রস্তাবটি টেবিলেই মেরে ফেলেছে। এর রেশ দেখাও গেছে; নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব উঠলে যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচ করে দেয়।
বুঝতে হবে, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ইস্পাতকঠিন মজবুত, যা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আটলান্টিকের এ পাড়ে ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন হয়েছে তাদেরই প্রত্যক্ষ মদদে ও তা তাদের-ই স্বার্থে।
বাস্তবতার বিচারে ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রকে যত না প্রয়োজন, তারচেয়ে বেশী প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইসরায়েলের। পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে কব্জায় রাখতে ইসরায়েলকে তারা সামরিক ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করে রেখেছে। তাই, ইসরায়েলকে রাষ্ট্র না বলে পশ্চিমাদের সামরিক ঘাঁটি বলাই শ্রেয়। আর তাই ইসরায়েল আজ এত দূর্বিনীত, বেপরোয়া ও হিংস্র। নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবে তারা তেমন বিচলিতও নয় এ কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দেয়ার সিদ্ধান্তের অর্থ এ নয় যে, আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) নীতিতে পরিবর্তন এসেছে।’
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য আড়াই বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র অনুমোদন করেছে। দূর্বল ইসরায়েল রাষ্ট্র তাদের কাছে অকল্পনীয়। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের ফিরে পাওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল কিছুটা নমনীয় ভাব দেখাবে। জিম্মি পর্ব শেষ হলেই তারা স্ব-রূপে ফিরে যাবে। নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রস্তাব না মানার কারণে জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নিতে দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। অতীতের ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে। অতএব, পাশ হওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের আপাতত উচ্ছাসিত না-হলেও চলবে। বরং অপেক্ষায় থাকতে হবে ইসরায়েল ও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের কতটুকু দয়া দেখায় সেদিকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।