শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ: এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল তারা

শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

এনএম ফখরুদ্দীন: বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য এ দেশের শিক্ষক সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী,চিকিৎসক, স্থপতি,ভাষ্কর, সমাজসেবী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সংস্কৃতিসেবী, সংগীতশিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য।

পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিল, তাদের পক্ষে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়, তখন তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে নবগঠিত দেশকে সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দূর্বল ও পঙ্গু করার নীলনকশা এঁকেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

১৯৭১ সালের ১০-১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অল্প সময়ে তারা বাছাই করে করে হত্যা করেছিল এ দেশের প্রথম শ্রেণির বহু বুদ্ধিজীবীকে। এ হত্যাযজ্ঞ বড়ই মর্মান্তিক! একটি জাতিকে জ্ঞানহীন ও মেধাশূন্য করতে তারা শেষ চেষ্টাটা করেছিল এমন নোংরা হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। তাদের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট ও কারণ কি ছিল আসুন দেখি।

ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ৬৯’-এর গণ-অভ্যুত্থানে তারা ছিলেন অনুপ্রেরণাদানকারী। কেউ কেউ সামনের কাতারে। বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচারের বিষয় সাধারণ মানুষকে অবগত করেছিলেন তারা। বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে- এ কথা সবাই জানত। কিন্তু, অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সারণীর মাধ্যমে যে সত্যটাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিল। তারাই সর্বপ্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুইটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি চালুর কথা বলেছিলেন। বাঙালি সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন আন্দোলনের প্রতিটি খবর শিল্পী-সাহিত্যিকরা গল্প-উপন্যাস, নাটক, গানসহ লেখনীর মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক মৌলিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রতি সচেতন করে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা কখনো স্বতন্ত্র, কখনো একই সঙ্গে করেছেন আন্দোলন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরা।

বিভিন্ন তথ্য ও গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায়; ভারতে আশ্রয় নেওয়া বুদ্ধিজীবীরা গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ যার সভাপতি ছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য হয়েছিলেন। এ ছাড়া, তাকে সভাপতি ও জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ। বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেল গঠন করেন। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সরবরাহ ও বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদীয় পার্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ সাহায্যের আবেদন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য প্রদান, শরণার্থীদের উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখেন। শরণার্থীশিবির শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ৫৬টি স্কুল খুলে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার উৎস ছিল। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। তারা আরও মনে করেছিল যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই, পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বাসা ও কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অনেকে ভাগ্যবশত মৃত্যু এড়াতে পেরেছিলেন। পরে বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিদেশে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। দিল্লি ও কলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবীরাও সে সময় বাংলাদেশের পক্ষে কলম ধরেছেন। জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। শাবানা আজমির বাবা বিখ্যাত উর্দু কবি কাইফি আজমি নিজের টাকা খরচ করে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। তাদের সেই ভূমিকার কথা বিস্মৃত হওয়ার নয়।

১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার ৭০। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চার ধাপে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক এখন পর্যন্ত শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলেন ৫৬০ জন শহিদ বুদ্ধিজীবী। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সাহিত্যিক রয়েছেন ১৮ জন, দার্শনিক একজন, বিজ্ঞানী তিনজন, চিত্রশিল্পী একজন, শিক্ষক ১৯৮ জন, গবেষক একজন, সাংবাদিক ১৮ জন, আইনজীবী ৫১ জন, চিকিৎসক ১১৩ জন, প্রকৌশলী ৪০ জন, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি ৩৭ জন, রাজনীতিক ২০ জন, সমাজসেবী ২৯ জন, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাট্যকার প্রমুখ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যশোর ও মানিকগঞ্জের বুদ্ধিজীবী বেশি। তার মধ্যে যশোরের ৩৭ জন ও মানিকগঞ্জে ৩৬ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, হত্যার শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নওগাঁর ২৮ জন ও ২৫ জন সিরাজগঞ্জের। তার পরের অবস্থানেই ঢাকায় শহিদ বুদ্ধিজীবীরা। গবেষকরা বলছেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রামের বাইরে বহু বুদ্ধিজীবী নিজ এলাকাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৩৮৬ জন মুসলমান, ১৬৭ জন হিন্দু, তিনজন বৌদ্ধ ও তিনজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।’ তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক। এর পরেই পেশার দিক থেকে আছেন চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, সংস্কৃতিসেবী ও শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। চার বারে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া ৫৬০ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আছেন ভারত ও ইতালির নয়জন শহিদ বুদ্ধিজীবী। ৪৬ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর এলাকার ঠিকানা পাওয়া যায়নি। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১টি জেলাতেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়।

নিহত বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শীর্ষ কয়েকজনের নাম আলতাফ মাহমুদ শহীদুল্লা কায়সার, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, সিরাজুদ্দীন হোসেন, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, মেহেরুন্নেসা, নিজামুদ্দীন আহমেদ, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, দর্শনশাস্ত্রের গোবিন্দ চন্দ্র দাশ, বাংলা সাহিত্যের মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী; ইতিহাসশাস্ত্রের আবুল খায়ের, শিক্ষা ক্যাডারের সিরাজুল হক খান ও ফাইজুল মাহী প্রমুখ।

বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অতি পরিচিতমুখ জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক বুদ্ধিজীবী হত্যা করতে সক্ষম হয়নি। তবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছুটা ব্যর্থ হলেও তারা বাঙালিকে মেধাশূন্য করার জন্য নির্ভূলভাবে গোপন তালিকা প্রনয়ন করেছিল কিন্তু।’

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আর সেই থেকেই ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন প্রতিজন বাঙালীর হৃদয়ে এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক কাহিনী স্মরণে অমর থাকবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।