রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ফিলাডেলফিয়ায় মুনার তিন দিনের কনভেনশনে জনস্রোত, ন্যায় প্রতিষ্ঠার ডাক

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৫, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ফিলাডেলফিয়া, পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র: উৎসবমুখর পরিবেশে অষ্টম বারের মত অনুষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) তিন দিনের কনভেনশন। ‘পিস এন্ড জাস্টিস ফর হিউম্যানিটি’ স্লোগান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরস্থ পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় এবারের সম্মেলন। যেখানে অংশ নেন দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কনভেনশনের আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থান ও গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনসহ বিভিন্ন বিষয়। এছাড়া, কনভেনশনে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিতদের মুক্তি কামনায় দোয়া ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়।

গেল শুক্রবার (৯ আগস্ট) বিকালে শুরু হয় এ কনভেনশন। যা চলে চলে রোববার (১১ আগস্ট) অপরাহ্ন পর্যন্ত। মুনা কনভেনশন ঘিরে পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টার মিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি মুসলিম কমিউনিটির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্থান থেকে কনভেনশনে যোগদানকারী অধিকাংশরাই ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। কনভেনশনের বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তাদের কথায় অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগ, আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম, অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার, অনিয়মের কথা উঠে আসে। পাশাপাশি, ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাধীনতা, গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন প্রভৃতি বিষয়ও উঠে আসে।

আয়োজকরা জানান, মুনা কনভেনশন ঘিরে শুক্রবার (৯ আগস্ট) সকাল থেকে দুপুরে নিউইয়র্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে হাজার হাজার মুসলিম নর-নারী সপরিবারে কনভেনশন সেন্টারে এসে মিলিত হন। নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলীন, ওজনপার্ক প্রভৃতি এলাকা থেকে একাধিক বাসযোগে হাজার হাজার বাংলাদেশি সপরিবারে কনভেনশনে যোগ দেন। আবার অনেকে ব্যক্তিগত গাড়িযোগে ফিলাডেলফিয়ায় আসেন। কনভেনশন আয়োজকদের ধারণা, এবারের কনভেনশনে ১২-১৫ হাজারের মত মুসলিম নর-নারীর সমাবেশ ঘটেছে।

বিশালাকারের পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টার ও এর আশপাশের এলাকা সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এবারের কনভেনশনে নয়া প্রজন্মের ব্যাপক উপস্থিতি। সামার ভ্যাকেশনের সুযোগে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কনভেনশনে অংশ নিয়েছেন বলে অনেকই জানান। এছাড়াও, কনভেনশনের আয়োজনেরও প্রশংসা করেছেন অনেকেই।

সরজমিনে আরো দেখা গেছে, লাইনে দাড়িয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। তারপর যোগ দিয়েছেন মূল অনুষ্ঠানে। এ দিকে, কভেনশনের বিভিন্ন আলোচনা ও সেমিনারের মাঝে মাঝে মুনার সোস্যাল সাভিস, আল কোরআন দাওয়াহ সেন্টার প্রভৃতি সংগঠনের কার্যক্রম ভিডিও কার্যক্রমের মাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি এসব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়। অন্যান্য হলে অনুষ্ঠিত হয় বিষয়ভিত্তিক সেমিনার। ছিল ইয়্যুথদের জন্য বিশেষ সেমিনার। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনেও বিভিন্ন মানববিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এ ছাড়াও কনভেনশনের স্পন্সর সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও সংক্ষেপে তাদের কর্মকান্ড তুলে ধরেন। কনভেনশন সেন্টারে বিভিন্ন পণ্যের ১৩৫টি স্টল স্থান পায়।

কনভেনশনে আগতদের স্বাগত জানান মুনার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট হারুন-অর রশীদ ও কনভেনর আরমান চৌধুরী। কনভেনশনের বিভিন্ন পর্বে আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে তিন দিনের আলোচনায় মুনার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, প্রাক্তন ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসেন ও আবু মোহাম্মদ নূরুজ্জামান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আবুল কালাম আজাদ বাশার, লন্ডন থেকে আসা হামিদ হোসেন আজাদ আলোচনায় অংশ নেন।

এতে আরো আলোচনা করেন নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম ও খতিব মির্জা আবু জাফর বেগ, ইয়াসির কাধি, ইমাম ওমর সুলেমান, ইমাম সিরাজ ওয়াহহাজ, মুফতি হুসাইন কামানি, শন কিং, ইমাম সুলেমান হানি, শায়খ আব্দুল নাসির জাংদা, উস্তাদ তাইমিয়া জুবায়ের, ইমাম মোহাম্মদ আবু তালেব, আলতাফ হোসেন, ইসমাহান আবদুল্লাহি, ওসামা আবু ইরশাইদ, সাইয়েদুর রহমান চৌধুরী, আবদুর রহমান খান, জাহিদ বুখারী, তাহির ওয়াইট, চৌধুরী মাহমুদ হাসান, ইমাম বাবা গালে ব্যারি, উসামা আল-আজামী, শেখ এ টিডিয়ান ডায়ালো, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহি, নিহাদ আওয়াদ, আবু সামিহা সিরাজুল ইসলাম, হাসান আবদেল সালাম, আয়মান হাম্মুস, সাবিল আহমেদ, মাহেরা রুবি, আবুদুল্লাহ বালদি, মহসিন আনসারী।

এ ছাড়াও আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য দেন পেনসেলভেনিয়া স্টেট সিনেটর নিখিল সাবা এবং পাকিস্তানি-আমেরিকান রাজনীতিক তারেক খান, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী আব্দুল আজীজ ভূঁইয়া।

কনভেনশনের বিভিন্ন পর্ব পরিচালনা করেন মুনার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ, কনভেনশনের কনভেনর আরমান চৌধুরী, সোস্যাল সার্ভিসের পরিচালক হাফেজ আব্দুল্লাহ আল আরীফ, মিডিয়া ও কালচালার বিভাগের পরিচালক আনিসুর রহমান গাজী, টিভি নিউজ প্রেজেন্টার ও আবৃত্তিকার সাইফুল্লাহ মনসুর।

যেভাবে সাজানো হয় তিন দিনের এ আয়োজন: কনভেনশন প্রথম দিন শুক্রবার (৯ আগস্ট) দুপুরে জুম্মার নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মুনা কনভেনশন শুরু হয়। পেনসেলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারের মূল মঞ্চে বিকলে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী পর্বের শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একাধিক তেলাওয়াতকারী। এদের মধ্যে ছিলেন কারী ইশতিয়াক বিন শফিক, কারী নজরুল ইসলাম, কারী আহমেদ মাবরুর, কারী হোসাইন সালেহ। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন কনভেনশন কনভেনর আরমান চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মুনার ন্যাশনার প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ইমাম বাবা গালী বারী, শাহীন সিদ্দিকী, লন্ডন থেকে আসা ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ, ফিলাডেলফিয়া সিটির মেয়রের প্রতিনিধি, আয়মান হামাস, মহসিন আনসারী, ওসামা জামাল, ইমাম সিরাজ ওয়াজি, সাইদুর রহমান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ থেকে আসা ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী সাইফুল্লাহ মনসুরের সঙ্গীত উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান।

পরবর্তী সেশনে ‘দ্য ইউনাইটেড গাইডলাইন্স’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন আবু মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, আলতাফ হোসাইন ও সাউন কিং। এরপর মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর ‘ইসলামের সভ্যতা ও ঐতিহ্য-যে জাতি আলো ছড়ায়’ শীর্ষক সেশনে ‘ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব’ বিষয়ে হামিদ হোসাইন আজাদ, সাঈদুর রহমান চৌধুরী ও ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী-আমাদের প্রেরণা’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন আবুল কালাম আজাদ বাশার।

এছাড়াও এ দিন মূল পর্বের আলোচনা ছাড়াও ইয়্যুথ কনফারেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য কনফারেন্স রুমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ও সেমিনারগুলোতে অতিথি আলোচকরা বক্তব্য দেন।

শনিবার (১০ আগস্ট) সকাল দশটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলে কনভেনশনের নানা অনুষ্ঠান আর কর্মকান্ড। এর মধ্যে ছিল বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সেমিনার, ইয়্যুথ প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ইসলাম, ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইমামদের ভূমিকা বিষয়ক আলোচনা পর্ব দিয়ে শুরু হয় শনিবারের কর্মকান্ড। নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের (জেএমসি) ইমাম ও খতিব মির্জা আবু জাফর বেগ ও বাংলাদেশ থেকে আসা আবুল কালাম আজাদ বাশারসহ বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের ইমামরা এ সময় বক্তব্য দেন। এছাড়াও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট আব্দুল আজীজ ভূইয়াও বক্তব্য দেন এ পর্বে। এছাড়াও মুসলিম সোসাইটি বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন আলতাফ হোসাইন, মুফতি হোসাইন কামানী ও সুলেমান। এরপর ‘ন্যায়পরায়ন সমাজ গঠনের পদ্ধতি’ বিষয়ে আলোচনা করেন আবু আহমেদ নূরুজ্জামান এবং ‘সফল দাওয়া-পদ্ধতি ও কৌশল বিষয়ে আলোচনা করেন আবুল কালাম আজাদ বাশার। এর পর ফিলিস্তিনি বিষয়ক আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ওসামা আবু ইরশাদ, ইমাম মোহাম্মদ আবু তালেব ও শায়েখ আবু নাসির জাংদা।

বিকলের অধিবেশনে মুনা সোস্যাল সার্ভিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরীফে উপস্থাপনায় ‘সামাজিক ন্যায়পরনায়তা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলাম’ শীর্ষক সেশনে ‘অন্যায় ও জুলুম সবসময় ন্যায় বিচারের জন্য হুমকী’ বিষেয়ে বক্তব্য রাখেন মুনার প্রাক্তন ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম দেলোয়ার হোসাইন এবং ‘মজবুত ঈমানের আলোয় আলোকিত হৃদয় সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের আলেম আবুল কালাম আজাদ বাশার।

এছাড়াও কীনোট সেশনে বক্তব্য দেন ওমর সোলাইমান, আলতাফ হোসাইন, হারুন-অর রশীদ। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন পেনসেলভেনিয়া স্টেট সিনেটর নিখিল সাবা, মূলধারার রাজনীতিক তারেক খান। এ দিনও মূল পর্বের আলোচনা ছাড়াও ইয়্যুথ কনফারেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য কনফারেন্স রুমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ও সেমিনারগুলোতে অতিথি আলোচকরা বক্তব্য দেন। এর পর মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর রাত নয়টার দিকে শুরু হয় মনোজ্ঞ ইসলামী সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পী ও আবৃত্তিকার তোফাজ্জল হোসেন খান, আতাউল ওসমানী ও ইকবাল হোসেন জীবনের নেতৃত্বে উম্মাহ শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরা দলীয় ও এককভাবে ইসলামী গান করেন। এছাড়াও রেনেসাঁ কালচারাল গ্রুপ, আটলান্টিক কালচারাল গ্রুপ, নায়াগ্রা কালচারাল গ্রুপ এবং মুনা চিল্ডরেন উইংয়ের নয়া প্রজন্মের শিল্পীরা গান করেন। এ পর্বের সঙ্গীতগুলোতেও বাংলাদেশ আর প্যালেস্টাইন পরিস্থিতি উঠে আসে।

তৃতীয় ও শেষ দিন সকাল দশটায় শুরু হয় তিনের দিনের কনভেনশনের সমাপনী অধিবেশন। এ দিন মূল মঞ্চের কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা, ইসলামী সঙ্গীত ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জয়ীদের মাঝে ‘মুনা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ পুরষ্কার বিতরণ। আলোচনা পর্বে ইসলামের আলোকে সুস্বাস্থ্য বিষয়ে বক্তব্য দেন হাফেজ জাকির আহমেদ, আলতাফ হোসাইন ও শায়েখ আব্দুল নাসির জাংদা। এ ছাড়াও শিশুবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন ডাক্তার মোহাম্মদ আবু তালেব ও ব্যারিস্টার হামিদ হোসেন আজাদ। অ্যাওয়ার্ড বিতরণী পর্বে হারুন-অর রশীদ বিজয়ী শিশু-কিশোর-কিশোরীদের হাতে অ্যাওয়ার্ড ট্রফি ও সার্টিফিকেট তুলে দেন। এর আগে মুনার চিল্ডরেন উইংয়ের নয়া প্রজন্মের শিল্পীরা দলীয় গান করে।