ঢাকা: টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পূর্বের রাতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জেনারেলদের সাথে বৈঠক করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কারফিউ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সেনারা বেসামরিক লোকদের ওপর সেনারা আর গুলি ছুড়বে না।
সংবাদ রয়টার্সের।
বৈঠকে জেনারেলরা এ কথা বলার পরপরই ওয়াকার উজ জামান ছুটে যান গণভবনে। তিনি শেখ হাসিনাকে এ বার্তা দেন যে, তিনি যে কারফিউ ডেকেছেন, তা বাস্তবায়নে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন সেনারা।
ভারতীয় একজন কর্মকর্তাও এ তথ্য জানিয়েছেন। এতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, শেখ হাসিনার পক্ষে সেনাবাহিনীর আর কোন সমর্থন নেই।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের অনলাইন মিটিং ও তারপর শেখ হাসিনাকে যে বার্তা দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে এর পূর্বে আর কোন রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। শেখ হাসিনা ১৫ বছর যেভাবে শাসন করেছেন তাও উঠে আসে। তিনি বিন্দুমাত্র ভিন্নমত পোষাণ করেন- এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এসবের কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আর আচমকা সোমবার (৫ আগস্ট) তার ইতি ঘটে। তিনি পালিয়ে যান ভারতে।
এর পূর্বে দেশব্যাপী কারফিউ দেয়া হয়। তাতে গেল ৪ আগস্ট আন্দোলনে কমপক্ষে ৯১ জন নিহত ও কয়েক শত মানুষ আহত হন। জুলাইয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরুর পর এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণহানির দিন।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী রোববার সন্ধ্যার আলোচনার ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল নিয়মিত মিটিং। সেখানে আপডেট নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বাড়তি প্রশ্ন করা হলে তিনি বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা বা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রয়টার্স শেখ হাসিনার শাসনের শেষ ৪৮ ঘণ্টার পরিস্থিতি বোঝার জন্য গেল সপ্তাহের ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত চারজন সেনা কর্মকর্তা ও এসব ঘটনা কাছ থেকে দেখেছেন- এমন দুইটি সূত্রসহ দশজনের সাথে কথা বলেছে। ব্যাপারটির সংবেদনশীলতার কারণে তাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
শেখ হাসিনা গেল ৩০ বছরের মধ্যে ২০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন। জানুয়ারিতে তিনি টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় আসেন। এর পূর্বে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেন। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। তিনি কঠোর হস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত আদালতের এক রায়কে কেন্দ্র করে তার সেই ক্ষমতা চ্যালেঞ্জে পড়ে। ছাত্রদের আন্দোলনে সেই রায় পরে সংশোধন করা হয়। কিন্তু, প্রতিবাদ বিক্ষোভ রূপ নেয় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে।
তবে, শেখ হাসিনার নিয়োগ দেয়া সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে জানাননি। কিন্তু, প্রতিবাদ বিক্ষোভের আকার ও কমপক্ষে ২৪১ জনের মৃত্যু শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব করে তোলে। এমনটা বলেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিন প্রাক্তন সিনিয়র কর্মকর্তা।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনে সেনাদের ভিতর ব্যাপক পরিমাণে অস্বস্তি ছিল। সেটি সম্ভবত সেনাপ্রধানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ, তার বাইরে থেকে ঘটনা দেখেছে, কি ঘটছে।’
সামি উদ দৌলা চৌধুরী বলেন, ‘এতে জীবন রক্ষার কথা ঘোষণা দেয়া হয়। কর্মকর্তাদেরকে ধৈর্য প্রদর্শন করতে বলা হয়।’ এতে প্রথমেই যে ইঙ্গিত মেলে, তা হল সেনাবাহিনী সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনে শক্তিপ্রয়োগ করবে না। ফলে, শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েন। সোমবার (৫ আগস্ট) কারফিউ অমান্য করে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহেদুল আনাম খানের মত সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা রাজপথে নেমে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে থামায়নি সেনাবাহিনী। আমরা যেটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেনাবাহিনী সেটাই করেছে।’