রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

শিরোনাম

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বাধিয়ে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করছেন বাইডেন

মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
জো বাইডেন

ডেস্ক প্রতিবেদন: ‘শান্তি’ বিষয়টা যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে যায় না। যুদ্ধ, সংঘাত ও অশান্তিই যেন তার ভিশন ও মিশন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই যুদ্ধ ও সংঘাতের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন তিনি। খবর সিএনএনের।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের মতই তিনিও ‘যুদ্ধবাজ’ তকমা পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়েছেন। তাইওয়ানকে অস্ত্র দিয়ে সংঘাত উস্কে দিচ্ছেন। এখন ফের ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধেও ইন্ধন যোগাচ্ছেন।

এরই মধ্যে ফের প্রেসিডেন্ট পদে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। শুরু করেছেন জোরালো প্রচারণাও। আর নির্বাচনে জিততে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ বাধিয়ে সেই যুদ্ধকে পুঁজি করে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তহবিল সংগ্রহে বিরোধী প্রার্থীদেরও টেক্কা দিচ্ছেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চলতি বছর তৃতীয় মেয়াদে সাত কোটি দশ লাখ ডলারেরও বেশি তহবিল সংগ্রহ করেছেন। নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহে বিরোধী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডেসান্টিসসহ রিপাবলিকান পার্টির অন্যসব প্রার্থীদেরও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। এর আগে দ্বিতীয় মেয়াদে উঠেছে নয় কোটি দশ লাখ ডলার। আর চলতি বছরের এপ্রিলে প্রচারণা শুরুর পর প্রথম মেয়াদে উঠেছিল সাত কোটি ২০ লাখ ডলার। বাইডেনের এই বিপুল নির্বাচনী তহবিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেনকে একজন ‘ধারাবাহিক যুদ্ধ আহ্বানকারী’ আখ্যা দেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর র‌্যান্ড পল। ইরাক যুদ্ধে সরাসরি সমর্থন দেয়ায় তার কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি। সেই সাথে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো যুদ্ধ ও সংঘাতে জড়াতে পারেন।’ সিনেটর র‌্যান্ড পলের সেই কথাই সত্যি হয়েছে। একের পর এক যুদ্ধ ও সংঘাত বাধাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ২০০৯-২০১৬ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাইডেন। ওই সময় সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যে যুদ্ধ এখনো কার্যত শেষ হয়নি। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১৯৭৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ছিলেন বাইডেন। এই সময়ে সার্বিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের মত দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তার সরাসরি সমর্থন ছিল। এসব যুদ্ধে তার সমর্থনের কারণে মারা গেছে প্রায় সাত লাখ মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয় আরো লাখ লাখ মানুষ।

২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ অভিযোগ তোলেন, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্র রয়েছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছেন তিনি। সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সাদ্দাম হোসেন, যা শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।’ ২০০২ সালের অক্টোবরে সিনেটর বাইডেন ইরাক যুদ্ধের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। যার মাধ্যমে বুশ প্রশাসনকে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর ক্ষমতা দেয়া হয়। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে আক্রমণের নির্দেশ দেন বুশ। যে যুদ্ধ চলে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ইরাক যুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় বাথ পার্টিকে। ফাঁসি দেয়া হয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। বর্তমানে ইরাকি বাহিনীকে প্রশিক্ষণের নামে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য রয়েছে। ওই যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান রয়েছে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের চালানো গবেষণা প্রতিবেদন মতে, ছয় লাখ ৫৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ৮৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা জানা যায়নি।

সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগে ইরাকে আগ্রাসান চালানো হয়, তেমন কোন অস্ত্র সেখানে পাওয়া যায়নি। ২০০৫ সালে সাক্ষাৎকারে ইরাক যুদ্ধের পক্ষে দেয়া ভোট দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বাইডেন বলেন, ‘এটি তার ‘ভুল সিদ্ধান্ত ছিল’।

২০১১ সালে সিরিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পদত্যাগ, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের দাবি জানায় বিক্ষোভকারীরা। সরকার বিক্ষোভে বলপ্রয়োগ করলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিদেশি শক্তি ও সন্ত্রাসী সংগঠন। ২০১১ সাল থেকে আসাদকে সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২০১৪ সালে বারাক ওবামা প্রশাসন সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। ২০১৫ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে প্রতিহত করতে দেশটিতে সেনা মোতায়েন করে ওয়াশিংটন।

গেল নির্বাচনের আগে বাইডেনের প্রচারণা শিবির দাবি করে, আইএস মোকাবিলাসহ বিভিন্ন কারণে ওবামা-বাইডেন প্রশাসন সিরিয়ার বিরোধীদের সহায়তা করেছে।

সিরিয়া যুদ্ধে প্রায় তিন লাখ ৮৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। যার প্রকৃত সংখ্যা অজানা। এরপর প্রায় একই সময়ে লিবিয়ার দীর্ঘ দিনের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ন্যাটোকে সর্বাত্মক সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র।

সে সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন, ‘লিবিয়ার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী দিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছেন গাদ্দাফি। নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। বাধ্য হয়ে লিবিয়ার নাগরিকরা প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। লিবিয়াসহ প্রতিবেশী মিশর, তিউনিসিয়ায় মানবিক সংকট তৈরি করছে।’

লিবিয়ায় ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুতের পর গাদ্দাফিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত বিদ্রোহীরা।সংঘাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। আড়াই থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত মানুষ মারা গিয়ে থাকতে পারে বলে বিভিন্ন সময়ের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সংঘাত এখনো চলছে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা ঘটে। দায়ী করা হয় আল কায়েদাকে। আল কায়েদাকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তোলা হয় সে সময়কার আফগান শাসক তালেবানের বিরুদ্ধে। একই বছরের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান জোরদারের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন বাইডেন। আফগান যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেছে, তার সঠিক তথ্য নেই।

নানা পরিসংখ্যান বলছে, ‘এক লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ মারা গেছে।’ প্রায় দুই দশকের আগ্রাসনের পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সাথে শান্তি চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ওই বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সেনারা। কাবুলের দখল নেয় তালেবান।

১৯৯৯ যুগোস্লোভিয়ায় (সার্বিয়া ও মন্টিনেগ্রো) বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে সমর্থন দেন বাইডেন। ওই বছরের মার্চে যুগোস্লোভিয়ায় বিমান হামলা চালায় ক্লিনটন প্রশাসন। কসোভো প্রদেশে আলবেনিয়া জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সরকারে চালানো নির্যাতনের অভিযোগে ওই হামলা চালানো হয়। ওই যুদ্ধ দেড় লাখের মত মানুষ নিহত হয়েছে।