আফতাব চৌধুরী: খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান আমাদের জীবনের তিনটি প্রাথমিক আবশ্যিকতা। এর মধ্যে বাড়ি সাধারণত আমরা জীবনে একবারই করে থাকি। আমরা যখন আমাদের জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণ করি, তখন মনে-প্রাণে চাই যে, সেটি যেন ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা ভেঙ্গে পড়ে জানমালের ক্ষতি না হয়। ঝড় ও বন্যা প্রায়শই ঘটে থাকে বলে সেগুলো সম্বন্ধে আমরা সচেতন, আর এ দুটি বিপদের পূর্বাভাসও কম-বেশি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, ভূমিকম্প আসে কালেভদ্রে এবং কোন পূর্বাভাস ছাড়াই। দুটি বড় মাপের ভূকম্পের মাঝখানে ব্যবধান এতই বেশি থাকে যে, আমরা এ ব্যাপারে সচেতনতাই হারিয়ে ফেলি। তাই, এ ব্যাপারে আরও বেশি আলোচনা, চর্চা ও জাগৃতির প্রয়োজন রয়েছে।
ভূকম্পরোধী বাড়ি বলতে সে রকম বাড়ি বুঝায়, যা দেশের ডিজাইন কোড অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এখানে ডিজাইন বলতে স্ট্রাকচার্যাল ডিজাইন বুঝতে হবে। প্রসঙ্গত, বলা যায়, ডিজাইন দুই রকমের হতে পারে, আর্কিটেকচার্যাল ও স্ট্রাকচার্যাল ডিজাইন। প্রথমটিতে সাধারণ নক্সা তৈরি করা ও বাড়ির বহিরঙ্গের সৌন্দর্য বিধান বুঝায়। এ ডিজাইনে বাড়ির কোন ভূকম্পরোধী গুণ উৎসারিত হয় না। স্ট্রাকচার্যাল ডিজাইন বলতে বুঝায় বাড়ির ব্যবহারগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুযায়ী বাড়ির ভিত যথাযথ শক্তি দেয়া। এটি একটি গাণিতিক ক্রিয়া; যা দেশের ডিজাইন কোড মেনে করতে হয়। এ ছাড়া, এতে কাঠামো বিশ্লেষণ (স্ট্রাকচার্যাল অ্যানালিসিস) ও কাঠামোর গতিবিদ্যার (স্ট্রাকচার্যাল ডাইনামিক্স) প্রয়োগ প্রয়োজন হয়।
বর্তমান নিবন্ধে ভূকম্পরোধী বাড়ি নির্মাণে কী কী বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দানের চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি বহুবিস্তৃত ও গভীর। রয়েছে পারিভাষিক সীমাবদ্ধতাও। ‘বাড়ি’ থেকে ‘বিল্ডিং’ শব্দটি বেশি অর্থদ্যোতক হলেও এখানে ‘বাড়ি’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের সাধ্যমত সরলভাবে পরিবেশনার চেষ্টা করব। বাড়ির প্রথম অঙ্গ হল ভিত। আমরা ভিত থেকে আলোচনা শুরু করব।
ভিতের মাটি যদি শক্ত হয় বা বাড়ির ভিত যদি পাথরের উপর করা যায়, তবেই তা হয় আদর্শ স্থল। ভিতের মাটির বহন ক্ষমতা ও নেমে যাবার (সেটেলমেন্ট) প্রবণতা পরীক্ষাগারে পরীক্ষার ও ক্ষেত্রিক পরীক্ষার দ্বারা বের করে নিতে হবে। ভিতের আপেক্ষিক ধস (ডিফারেন্সিয়েল সেটেলমেন্ট) বাড়িকে বাসের অযোগ্য করে ফেলতে পারে। পৃথক পৃথক খুঁটির ভিত (ইনডিপেন্ডেন্ট ফুটিং) বিশিষ্ট বাড়ি হলে ভিতগুলোকে টাই বিম দিয়ে জুড়ে দিলে আপেক্ষিক ধসের প্রবণতা কমে যায়। ভিতের মাটি নরম হলে মাদুরে ভিত (ম্যাট বা র্যাফট ফাউন্ডেশন) ব্যবহার করা যেতে পারে। বহুতল বাড়ির ভিতের মাটি নরম হলে পাইল ব্যবহার করতে হবে। পাইল ব্যবহারে বাড়ির ভূকম্পরোধী ক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে, পাইল দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করে নিতে হবে আর পাইল নির্মাণ সঠিক হওয়া চাই। বহুতল বাড়ির জন্য মাটির পরীক্ষা যথেষ্ট গভীরতা পর্যন্ত হওয়া প্রয়োজন। ভূমিকম্পে ভিত সম্পর্কীয় সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হল পানি মিশ্রিত বেলে মাটি বা পলি মাটি। এ ধরনের মাটিতে ভূকম্পকালীন কম্পনে মাটির তরলীকরণ (লিকুয়েফ্যাকশন) ঘটে ও বাড়ির কাঠামোর ক্ষতি না ঘটেও পুরো বাড়িটি হেলে পড়তে পারে আর বাসের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। ১৯৬৪ সালে জাপানের ভূমিকম্পে অনেক বাড়ি এভাবে অনাবাসযোগ্য হয়ে পড়ে। এ ধরনের মাটিতে বাড়ি না বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাড়ির নক্সা (প্ল্যান) তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সেটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত (রেগুলার) হয়। আয়তাকার বা বর্গাকার প্ল্যান বাঞ্চনীয়। ইংলিশ ‘এল’ বা ‘ইউ’ আকারের প্ল্যান ভূকম্পরোধে সাহায্য করে না। বরং মোচড় (টর্সন) খাওয়ার ফলে বাইরের খুঁটিগুলো সহজেই ভেঙ্গে পড়ে। কোন বাড়ি বিশেষ কারণে ‘এল’ বা ‘ইউ’ আকারের প্ল্যানে তৈরি করা অনিবার্য হলে ‘এল’ বা ‘ইউ’র প্রতিটি বাহুকে একক বাড়ি হিসেবে তৈরি করতে হবে আর এদের মধ্যে থাকবে সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী ফাঁক। এ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সুবিন্যাসটি বিম ও খুঁটির প্রতিস্থাপনায়ও থাকা চাই। খুঁটিগুলো সমান দূরত্বে ও সমসত্ব বণ্টনে থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিক ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাড়ির বহিরাঙ্গ সৌন্দর্য থেকে বাড়ির ভূকম্প সুরক্ষার দিকে অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দক্ষ বাস্তুকারের দ্বারা স্ট্রাকচার্যাল ডিজাইন করে নেওয়ার পর নক্সার পরিবর্তন করা ঠিক নয়। শিয়ার ওয়াল ব্যবহার করলে বাড়ির দুটি উল্লম্ব অভিমুখেই এর পরিমাণ সমান হওয়া চাই।
বাড়ির উচ্চতা বরাবর থাকবে সুসামঞ্জস্য ও সুবিন্যস্ত। আচান কোন তলায় বাড়ির নক্সা পরিবর্তন করা বিধেয় নয়। বিভিন্ন তলার উচ্চতাও সমান হওয়া উচিত। খুঁটি বা শিয়ার ওয়াল ভিত থেকে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত যাবে। মাঝে কোথাও এর ছেদ ঘটানো ঠিক নয়। ভারবাহী অঙ্গগুলোর আকারে আকস্মিক পরিবর্তন আনা ঠিক নয়।
বাড়িতে রাখা আসবাবপত্র ছাড়াও অকাঠামোগত (নন-স্ট্রাকচার্যাল) অংশগুলো ভর (ম্যাস) বাড়ায়। এ ভর যথেচ্ছভাবে বিন্যস্ত হলে বাড়ির ভূকম্পরোধী গুণ কমে যাবে। ভর বিন্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন অবাঞ্ছনীয়। উদাহরণস্বরূপ- কোন একটি তলায় একটি ঘরে ভরের ঠাসাঠাসি কাম্য নয়। আবার বাড়ির কোন একটি তলায় সাঁতারের পুকুর (সুইমিং পুল) তৈরি করলে উচ্চতা বরাবর ঘটে ভরের অসামঞ্জস্য। ভূমিকম্পে এ ধরনের বাড়ি ভেঙ্গে যাবার দৃষ্টান্ত রয়েছে। কয়েক বছর আগে ভারতের গুজরাট ভূমিকম্পে এ রকম ঘটনার প্রচুর নজির রয়েছে।
বাড়ির মধ্যাকর্ষণজনিত ভার বা ওজন বিমের মাধ্যমে প্রথমে খুঁটিতে ও খুঁটির মাধ্যমে ক্রমে ভিতের মাটিতে চলে যায়। এভাবে তৈরি হয় ভারবাহী পথ। এ পথে বিচ্ছিন্নতা থাকলে ঘটে বিশৃঙ্খলা। উদাহরণস্বরূপ- ছাদ থেকে নেমে আসা কোন খুঁটিকে এক তলায় ভিত পর্যন্ত আসতে না দিলে এ খুঁটিতে নিম্নগামী ভার কাছের অন্যান্য খুঁটি দিয়ে নেমে আসবে। আর এ খুঁটিগুলো হয়ে পড়বে অধিক ভারাক্রান্ত। ফলে, ভূকম্পে ভারাক্রান্ত খুঁটিগুলোর ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে বেশি।
ছাদে পানির চৌবাচ্চা বসিয়ে দেওয়া আজকাল খুব চল হয়েছে। চৌবাচ্চা ছোট হলে তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু বড় মাপের পানির চৌবাচ্চা বা অনেকগুলো চৌবাচ্চা ছাদে বসালে বিপদ ডেকে আনে। মনে রাখতে হবে, ভূকম্প ভর ভালবাসে না। এ সমস্যার সমাধান কী? কারণ পানি তো আমাদের চাই। সরকারি ক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে উঁচু করে তৈরি পানির ট্যাঙ্ক (ওভার হেড ট্যাঙ্ক), যা বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কহীন হবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে ছোট চৌবাচ্চা ব্যবহারে সমস্যার কিছুটা লাঘব ঘটবে। সঠিক পদ্ধতি হল কম্পিউটার মডেলে পানির চৌবাচ্চা ধরে নিয়ে কাঠামোর বিশ্লেষণ ও ডিজাইন করা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার (প্রথম স্বর্ণপদক)