আবছার উদ্দিন অলি: ডিজিটাল যুগে ভালবাসার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন কে কাকে ভালবাসে, আর কে বাসে না- সেটা বুঝাই খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালবাসায় বিশ্বাসের জায়গা শুন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ভালবাসার রঙ বদলায় চাওয়া পাওয়ার এ জীবনে, নিজেকে হারায় যুগে যুগে প্রিয়জনে, স্বার্থের টানে যদি ভালবাসার মাপকাঠি হয়, সে ভালবাসায় নেমে আসে পরাজয় জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, সত্যিকারের ভালবাসা যদি থাকে মনে প্রাণে, সেই মানুষের বন্ধন চিরজীবন হয়ে উঠে, ভালবাসার আপনজনে।
১৪ ফেব্রুয়ারী ভালবাসা দিবস। ভালবাসার দিন, ভাল লাগার দিন। সব সময় ভালবাসা সবার জন্য, ভালবাসা প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতিক্ষণ। দেশের জন্য ভালবাসা, সন্তানের জন্য ভালবাসা, বাবা-মার জন্য ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা, বন্ধু-বান্ধবের ভালবাসা, প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসা, শুভাকাঙ্খী ও শুভার্থী জন্য ভালবাসা। সব ভালবাসার মূলমন্ত্র একটাই, সেটা হল নিজেকে অন্যের সুখ দুঃখ, হাসি কান্নায় অংশীদার করা। ভালবাসার জন্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন সুন্দর মন। রুচিশীল চিন্তাভাবনা। কারো ক্ষতি না করার মনমানসিকতা গড়ে তোলা, ভালবাসায় কারো ক্ষতি ও অহংকার থাকা কাম্য নয়। নিজের সুন্দর মনটাকে সুন্দরভাবে অন্যকে উপস্থাপন করাই ভালবাসা।
শরীরের প্রতি আকাংঙ্খা, নারী লোভ, মানিব্যাগের প্রতি দূর্বলতা, আধুনিকতার নামে উশৃংঙ্খলতা, উগ্রতা, বিদেশী সংস্কৃতির ছায়া অনুকরণ, আমাদের প্রকৃত ভালবাসা কালো আধাঁরে অন্ধ গলির চোরাপথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তির ভাল দিকটার চাইতে খারাপ দিকটাই ঝুঁকে পড়েছে। সাইবার ক্রাইম, ইয়ারা ট্যাবলেট, উগ্র পোশাক, মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক আইফোনসহ অন্য সব ব্যবহৃত জিনিসপত্রে নগ্ন ছবির ব্যবহার ও তরুণ-তরুণীদের নগ্ন দৃশ্যধারন করে ব্ল্যাক মেলিং চলছে। যার কারণে ভালবাসা, পশুত্বের রূপ লাভ করছে। হচ্ছে খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, যৌন হয়রানী, ইভটিজিং, বিবাহ বিচ্ছেদ, কিশোর গ্যাং, মাদকের প্রতি আসক্তিসহ ছড়িয়ে পড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা।
চারটি অক্ষরের একটি শব্দ ভালবাসা। প্রেমের ধরণ হরেক রকম। এ প্রেমকে নিয়ে কবি কবিতা লিখেছেন, গীতিকার লিখেছেন গান, সাহিত্যিক তার ভাষায় প্রকাশ করেছেন নানা রকমের চিন্তাধারা। শিল্পী প্রেম নিয়ে গেয়েছেন গান সেই সাথে বাদ পড়েনি এমনকি বিজ্ঞানীও। দেশে এখন প্রেমিক-প্রেমিকার সংখ্যা এত বেশী যে, কল্পনার বাইরে। তা বুঝা যায় শহরে একটা কফি হাউসও প্রতিদিন একটি ঘন্টার জন্যও খালি থাকে না। জোড়া জোড়া কপোত-কপোতি নিরবে আপন মনের কথা বলে যায় ডেটিং স্পটগুলোতে। আবার কখনো খখনো এখানে ভিলেন, মাস্তান, বখাটেদের আড্ডা বসে। হয়তো একটু উঁকি কিংবা কিছু বাংলা ছবির সংলাপ বড় গলায় বলার জন্য।
আবহমান কাল হতেই প্রেম করতে গিয়ে অনেকে হয়েছে নি:স্ব। ছেলে মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের কোন তোয়াক্কাই করেনি অভিভাবকেরা। যদি কোন ছেলে মেয়ে প্রেম করতে গিয়ে কোন বিপদে পড়েছে, তাহলে তাকে করা হয়েছে সমাজচ্যুত, কলংকিত এমনকি দৈহিক নির্যাতন করে তার অভিলাষকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রেম করাটা আসলে কেউ ভাল চোখে দেখে না। যদি কোন অভিভাবক শুনে তার ছেলে-মেয়ে প্রেম করছে, অতঃপর বিয়ে করবে তাহলে কোনভাবেই সেই প্রেম সার্থক হতে দেয় না। ছেলেটা যতই ভাল হোক শিক্ষিত, ভদ্র, ঘরবাড়ী, আয় রোজগার থাকুক না কেন, তার অপরাধ সে প্রেম করেছে।
এ সমাজে ছেলে-মেয়েদের প্রতিদিনই মিডিয়ায় প্রেম শেখানো হচ্ছে। এমন একটা রীতি গতানুগতিক ধারায় চলে আসছে- প্রেম করে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না। বড় একটি কুসংস্কার আমাদের সমাজে বিরাজ করছে, একটা সুন্দর মন আর সহনশীল ও আন্তরিক মনোভাব বড় বেশী প্রয়োজন এ ক্ষেত্রে। ভালবেসে কেউ ঘর বাঁধে, কেউ ঘর ছাড়ে। তবু মানুষ প্রেম করে ও অনাদিকাল করবে। প্রেম পবিত্র ও পরিস্কার বাস্তবমুখী খাঁটি সুন্দর মন ও মননশীলতার ভেতরে গড়ে তুলতে হবে। তবে, প্রেমটা হবে নজর কাড়ার মত।
এসএমএস, ই-মেইল, ফেইসবুক, ইন্টারনেটে চলছে ভালবাসার আলাপচারিতা। ভুল বানান রুচিহীন মেসেজ, অর্ধনগ্ন ছবি আদান-প্রদান চলছে। ভালবাসার পাত্র-পাত্রীরা মোবাইল কোম্পানীর ফ্রি টকটাইম ও এসএমএসের বিশেষ ছাড় কখন আসবে, সে অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গণে। ফেসবুকে নতুন নতুন ছবি ডাউনলোড করা, ই-মেইলে নতুন মন্তব্য লেখা চলছে সমানতালে। হোক শুদ্ধ কিংবা ভুল বানান। রুচিহীন ভালবাসা চলছে, চলবে। আবার কেউ কেউ বাজার থেকে মেসেজ বই কিনে, ম্যাগাজিন কিংবা নতুন কোন বই থেকে মেসেজ কপি করে প্রিয়জনকে পাঠাচ্ছে। নকলের জোয়ার চলছে। হাতের লেখা চিঠির সেই আবেগ, এ গভীরতা নেই, সেই হৃদ্যতা এখন আর দেখা দেয় না। নিবিড় সুখের বন্ধন আর প্রেমের রহস্যময়তা কিংবা ভালবাসার যত ছলকলা ভিন্নরূপে ভিন্ন মেজাজে উপস্থাপনা হচ্ছে। তবুও ভালবাসা, ভালবাসার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। ভ্যালেন্টাইন ডে ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রাখুক অনন্তকাল।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার, চট্টগ্রাম