শাহরিয়ার হান্নান: চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সুচিয়া গ্রামের ফটোগ্রাফার বাবা শচীন ভট্টাচার্য ও সঙ্গীত শিল্পী মা প্রতিভা ভট্টাচার্যের সংসারে চার ভাইয়ের বড় বোন শিপ্রা চৌধুরী। চাচাতো বোন তন্দ্রাদিদির নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করা দেখে শখ হয় অভিনয় করবেন, পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতার করবেন। সেই সুত্রে এমএ সালাম সাহেবের মাধ্যমে হাবিবুর রহমান জালালের নির্দেশনায় ১৯৬৭ সালে প্রথম অভিনয় করেন পলিটেকনিক্যাল কলেজের ‘কুয়াশা কান্না’ নাটকে কিশোরি মেয়ের চরিত্রে। এ নাটকে অভিনয় করে তিনি ১০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। সে বছরই ডাক্তার কামাল এ খানের পরিচালনায় পোর্ট ট্রাস্টের ‘শাহজাহান’ নাটকে জহরতুন্নেসা চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর একের পর এক অফিস পাড়ার নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রথম নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন চৌধুরী মুজিবর রহমানের পরিচালনায় ‘এরাও মানুষ’ নাটকে। অভিনয় শেখার জন্য শিপ্রা চৌধুরী এ গুণি পরিচালকের কাছে কৃতজ্ঞ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে ছিলেন আনোয়ারায় পিসির বাড়ি। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সাল হতে নতুন উদ্যোমে নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। প্রথম করেন লালদিঘীর ময়দানে অলোক কুমার দত্তের পরিচালনায় ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে। সে সময় নারি অভিনেত্রীর সংকটের কারণে প্রায় নাটকেই শিপ্রা চৌধুরীর ডাক পড়ত। সিএম রোজারিও, প্রণব কুমার দাশ গুপ্ত, রবিউল আলম, একেএম আসাদুজ্জামান সোলেমান খোকা, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, ড. আজম, মিঞা আব্দুল জলিল, মাহবুবুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক নবী, জাকির হোসেন, সাদেক আলী, মো. মহসিন, গিয়াস উদ্দীন, এমএ বারী, সৌমেন ইন্দু, চিত্ত দত্ত, নির্মলেন্দু, শেখ মতিউর রহমান, পঙ্কজ পাল, সুদর্শন চক্রবর্তী, দীপক বৈদ্য, রুপায়ন বড়ুয়া, সমীরন চৌধুরী, পঙ্কজ বৈদ্য সুজন, মানস বৈদ্য প্রমুখ পরিচালদের নির্দেশনায় অফিস পাড়ার অনেক ভাল ভাল প্রযোজনায় মুসলিম হল, ওয়াজিউল্লাহ ইনষ্টিটিউট, সেন্ট প্লাসিড, সিএন্ডবি, পলোগ্রাউন্ড, চিটাগাং ক্লাব, জেএম সেন হলসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন মঞ্চে শিপ্রা চৌধুরী অভিনয় করেছেন এখনো করছেন। চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন জেলায় নাটক করতে গেছেন। নাটক করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ও বাঁধার সম্মুখীন হলেও শিপ্রা চৌধুরী তার আদর্শের জায়গা হতে কখনো বিচ্যুত হননি ও তার পরিবার সব সময় তার সাথে ছিল বলে তিনি সব প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে তার কাজ করে গেছেন।
গুণি সঙ্গীত পরিচালক নৃপেন চৌধুরীর সাথে পারস্পরিক ভাল লাগা থেকে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী সংস্কৃতিমনা হওয়ায় শিপ্রা চৌধুরীকে শ্বশুর বাড়ির লোকদের মন জয় করে নাটক চালিয়ে যেতে বেগ পেতে হয় নি। তাদের সংসারে একমাত্র কন্যা তৃষ্ণা চৌধুরী বাবা তাকে আদুরি বলে ডাকত। তাদের সংসারে সুখের অভাব কখনো হয় নি। ১৯৮৭ সালে ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস (ডিভিপি) রোগে স্বামীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলেও শিপ্রা চৌধুরী রাজী হন নি। নাম করা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থাকলেও অভিনয়ের ভালবাসায় তা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
প্রায় হাজার রজনির অভিনেত্রী শিপ্রা চৌধুরীর অসংখ্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শেষফল, অথচ অন্ধকার ক্ষুধা, বিশ বছর আগে, আজকাল, জানোয়ার, আবর্ত, অন্ধকারের নীচে সূর্য, একটি পয়সা, বারো ঘন্টা, উত্তর ফাল্গুনী, সংসার, সূর্য মহল, বিশ্বাসঘাতক, অনুসন্ধান, সেইম সাইড, চারিদিকে যুদ্ধ, মেরাজ ফকিরের মা, তোমরাই, ইবলিশ, সুবচন নির্বসনে, এখনই সময়, এখানে নোঙ্গর ইত্যাদি। স্টিল মিল কর্তৃপক্ষের ‘চার দেয়ালের গল্প’ নাটকে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন তৎকালীন স্টি মিলে কর্মরত পরবর্তী বিখ্যাত অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেনের সাথে। আনোয়ার হোসেন, গোলাম মোস্তফা, প্রবীর মিত্রের সাথে একই মঞ্চে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে আলেয়া চরিত্র ১৯ রজনী অভিনয় করেছেন। মমতাজউদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় মুসলিম হলে ‘নীল দর্পন’ নাটকে তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে নাটক শেষে মমতাজউদ্দিন আহমেদ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, যা তাকে আজো গর্বিত করে। নাটক করতে গিয়ে দর্শকের ভালবাসা তাকে অভিভুত করে। নাটক শেষে দর্শকরা তাকে তাদের ভাল লাগার কথা জানান। তারা আশ্চর্য হন, কিভাবে চরিত্রে একাত্ব হয়ে তিনি হাসেন, কাঁদেন! চরিত্রের প্রয়োজনে রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করলে তা সত্য ভেবে তারা ভ্রম করেন।
শিপ্রা চৌধুরী ১৯৭২ সাল হতে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত নাট্য শিল্পী। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য বেতার নাটক করেছেন। শিপ্রা চৌধুরী বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেশ কিছু নাটিকা, নাটক ও ধর্মীয় নাটকে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে শেখ শওকত ইকবালের পরিচালনায় সুখ, দিন বদলের পালা, অরিন্দম মুখার্জি বিংকুর পরিচালনায় ‘বলা হয় নি তারে’, বিবিসি মিডিয়ার হয়ে অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা পটভুমিতে ‘গ্রানি’স টেল’ নামে একটি কাজ করেছেন। টেলিফিল্ম নির্মাতা নুরুল ইসলাম নুরুর অসংখ্য টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি।
নাটকের কাজের ব্যস্ততায় ও ভালবাসায় খুব বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করা হয়ে উঠে নি। তবে কয়েক বছর আগে পঙ্কজ বৈদ্য সুজনের সূত্রে একে সোহেলের ‘পবিত্র ভালবাসা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এতে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতা ফেরদৌস তাকে যে সম্মান দেখিয়েছেন, তা তিনি অনেক বড় প্রাপ্তি মনে করেন। অতি সম্প্রতি তানিম রহমান অংশুর পরিচালনায় ‘ন ডরাই’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিন্দোল রায়ের সুত্রে কাজ করেছেন। এতে তার নাতনি হৃদিতা চক্রবর্তী মিঠিও অভিনয় করেছে। সুনির্মিত চলচ্চিত্রটির সাথে সাথে তার অভিনয় সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
অভিনয়ের স্বিকৃতি স্বরুপ শিপ্রা চৌধুরী কল্লোল, অবসর সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, জন্মাষ্টমি পরিষদ, মহানগর পুজা উদযাপন পরিষদ, বেনানাশিস, গিমার্স, কেপিএমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
একটা সময় চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিষ্ঠিত অফিসেই নাটক মঞ্চস্থ হত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গ্রুপ থিয়েটার বিস্তার লাভ করলেও অফিস পাড়ার নাটকের কার্যক্রম ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে। তবে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ক্লাবগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ও বিভিন্ন পুজা অর্চনায় যে নাটক মঞ্চস্থ হয়, তাতে শিপ্রা চৌধুরী এখনো অপরিহার্য নাম।
তার কন্যা তৃষ্ণা চৌধুরী পড়ালেখা শেষে থিয়েটারের সাথে যুক্ত হলেও অভিনয় পেশার অনিশ্চয়তা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিপিং লাইনে চাকরি করছেন। কিন্তু মায়ের নাটকের প্রতি ভালবাসা তাকে অভিভূত করে। তাই মায়ের অভিনয় পথ মসৃন করার জন্য সব রকমের সহযোগিতা ও ত্যাগ স্বিকারের জন্য সে প্রস্তুত।
শিপ্রা চৌধুরী মঞ্চে অভিনয়কে পূজার আরাধনা বলে মনে করেন। তার ইচ্ছে অভিনয় করতে করতেই যেন তার মৃত্যু হয়।