বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

মনমরার ঝুঁকি অনেক

মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

ডাক্তার মুনতাসীর মারুফ: বন্ধু বা বান্ধুবির সাথে মনোমালিন্য বা দাম্পত্য কলহ, পরীক্ষায় ফেল, পথে বা কর্মস্থলে কারো দুর্ব্যবহার, নাটক-চলচ্চিত্রে প্রিয় চরিত্রের মৃত্যু, খেলায় প্রিয় দলের পরাজয়, পুরনো কোন স্মৃতি রোমন্থন- দৈনন্দিন জীবনযাপনে মন খারাপের কারণের তো শেষ নেই। এই মন খারাপকে আমরা মনমরা বা বিষণ্নতা বলেই জানি। যে কোন নেতিবাচক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট এই দুঃখবোধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। তবে, বিষণ্নতা দীর্ঘ মেয়াদি হলে তা যে কোন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বিষণ্নতার চিহ্ন: বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই মন প্রচণ্ড খারাপ বা ভার হয়ে থাকে। যেসব ঘটনা বা খবরে স্বাভাবিক অবস্থায় মন ভাল বা প্রফুল্লবোধ হওয়ার কথা, সেসবে রোগীর মানসিক অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। এর পাশাপাশি, অধিকাংশ রোগীর আরো যেসব সমস্যা হয়, সেগুলো হচ্ছে- কোন কাজে আনন্দ, আগ্রহ বা উৎসাহ না পাওয়া; মনোযোগের অভাব; সিদ্ধান্তহীনতা; ঘুমের সমস্যা, ঘুম আসতে দেরি হওয়া, তাড়াতাড়ি ভেঙে যাওয়া বা ঘুম ভাঙার পর আর আগের মত সতেজ বা চাঙ্গা না লাগা; খাবারে অরুচি; ওজন হ্রাস; নেতিবাচক চিন্তা; অযৌক্তিক বা অতিরিক্ত অপরাধবোধ; অল্পতেই ক্লান্তি; চিন্তা ও কাজের ধীরগতি; আত্মহত্যা প্রবণতা।

বিষণ্নতার প্রভাব: বিষণ্নতার মানুষের কর্মক্ষমতা বাধাগ্রস্ত বা নষ্ট করে দেয়। এমনকি অনেকেই দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ করতেও অসমর্থ হয়ে পড়েন। ফলে, পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রসবের পর নারীর বিষণ্নতা সন্তানের বেড়ে ওঠায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষণ্নতার সাথে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের ঝুঁকিও কম নয়। অনেক সময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগী আত্মহত্যা করে বসতে পারে।

বিষণ্নতার ঝুঁকি: যে ব্যক্তির পরিবারে বিষণ্নতা রোগের ইতিহাস রয়েছে, অর্থাৎ যার পিতা-মাত ও ভাই-বোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন বা ছিলেন, তার বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পরিবেশ, পারিবারিক পরিবেশ, শৈশবে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, ব্যক্তিত্বের গঠন ইত্যাদিও এই রোগের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রিয় কারো সাথ সম্পর্কচ্ছেদ, শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি ইত্যাদি বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ায়।

শিশুর বিষণ্নতা: বড়দের মত শিশুরাও বিষণ্নতায় ভোগে। তবে, শিশুদের চিন্তা-ভাবনা বা প্রকাশের ক্ষমতা বড়দের মত হয় না বলে অনেক ক্ষেত্রে মন খারাপ হওয়ার কথা শিশুরা না-ও বলতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে বিরক্তি, অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজই বিষণ্নতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। এ ছাড়া, স্কুলে যেতে অনীহা, পড়ায় মনোযোগ না পাওয়া, সমবয়সীদের সাথে মিশতে বা খেলতে অনাগ্রহ, একা একা চুপচাপ থাকা প্রভৃতি উপসর্গও দেখা যায়।

বিষণ্নতার চিকিৎসা: বিষণ্নতা একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। রোগের তীব্রতাভেদে ওষুধ অথবা সাইকোথেরাপি বা একই সাথে উভয় পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করা যায়। মৃদু বিষণ্নতার ক্ষেত্রে ওষুধ না-ও লাগতে পারে; সাইকোথেরাপি ও পারিবারিক-সামাজিক সহায়তাই তখন মূল চিকিৎসা পদ্ধতি। মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োজন হয় বেশির ভাগেরই। ওষুধে উপসর্গ কমে গেলেও রোগীর পারিপার্শ্বিক অবস্থাভেদে চিকিৎসকের পরামর্শমত দীর্ঘ সময় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে।

মন ভাল রাখতে: মন ভাল রাখতে বা বিষণ্নতা এড়াতে দৈনন্দিন জীবনে কিছু বিষয় মেনে চলতে বা পালন করতে হবে। আর চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি কিছু ব্যাপারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন- সুষম ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ; পর্যাপ্ত সময় ঘুম; ইতিবাচক পারিবারিক সম্পর্ক ও পরিবেশ বজায় রাখা; সুস্থ ও স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক চর্চা; রুটিনমাফিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন; কাজ ও বিশ্রামের সময়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা; নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা ইত্যাদি।

যা করা যাবে না: মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে এমন কথা বা কাজ; ধূমপান ও মাদকাসক্তি; অন্যের সাথে তুলনা; অবাস্তব বা অযৌক্তিক প্রত্যাশা; নেতিবাচক মানুষের সঙ্গ; মোবাইল বা ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার ইত্যাদি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট