সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার এক অনন্য গুণবান ব্যক্তিত্ব ইন্তাজির খান। শিক্ষা সমাজসেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। উপজেলার পাঠানটিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯১৮ সালের ৬ জানুয়ারি। তাঁর পিতার নাম মদরিছ খান। মায়ের নাম সিতারা বানু চৌধুরী। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ইন্তাজির খান ছিলেন দ্বিতীয়। শিক্ষিত মসুলিম পরিবারে জন্ম নেয়া ইন্তাজির খান ছিলেন একজন সুশিক্ষিত লোক।
ইন্তাজির খান মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারিয়ে ছিলেন। সিলেট সদর থানার কুচাই ইউনিয়নের নয়াগাওঁ গ্রামে খালার বাড়িতে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পরে ১৯৩৭ সালে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন (বর্তমান এসএসসি সমমানের)। ১৯৩৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে উচ্চ শিক্ষা পিপাসু ইন্তাজির খান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে বিএ পাশ করেন ১৯৪২ সালে।
সেই সময়ে মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়দের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সহজসাধ্য ছিল না। তাদেরকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হত।
ইনতাজির খান অনেকের ধারণা মতে ফেঞ্চুগঞ্জের প্রথম গ্রাজুয়েট। উনার পরে অবশ্য উনার নিকট আত্মীয়সহ তৎকালীন আরো কিছু গ্রাজুয়েট ডিগ্রীপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।কেউ কেউ দাবি করেন, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শচী বাবুও বিএ পাশ করেছিলেন। কিন্তু জানামতে তিনি ছিলেন আইএসসি পাশ সায়েন্সে ছাত্র ও অংকের শিক্ষক, তখনকার মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। চাকুরীতে থাকা অবস্থায় ওই সময়ে বিএ পাশ করার সুযোগ ছিল কিনা এটাও ভাবার বিষয়।
সেই সময়টাতে এলাকায় উচ্চ শিক্ষিত লোকের খুব অভাব ছিল। যে দুয়েকজন ভাল শিক্ষিত ছিলেন, তাদের খুব কদর ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে ভাল চাকুরির প্রস্তাব আসতো। কিন্তু তৎকালীন ফেঞ্চুগঞ্জ থানার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে পারিবারিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় ও স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক শচী বাবুর অনুরোধে ১৯৪৫ সালে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগদান করেন ইন্তাজির খান। উনার ও তৎকালীন প্রধান শিক্ষক শচী বাবুর হাত ধরেই এই স্কুল মাইনর স্কুল থেকে হাই স্কুলের মর্যাদা লাভ করে।
পর্রবতী কর্মরত থাকা অবস্থায় বিটি সনদ লাভ করেন। ১৯৫৫ ইংরেজিতে তিনি কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সমগ্র সিলেট জেলার হাতে গুনা কয়েকটি হাই স্কুলের মধ্যে কাশিম আলী হাই স্কুল হল একটি, যার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি।
শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ ইন্তাজির খান জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু কাসিম আলি উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যয় করেন। ১৯৮৩ সালের মে মাস পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৮ বছর কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সরকারি অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। যেমন কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের দীর্ঘ দিন প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ভারত ও পাকিস্তানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ও শীক্ষা সফরে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।।
ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাশিম আলী হাই স্কুলে পশ্চিম পাকিস্তানের এক প্রতিনিধি দল শিক্ষা সফরে এসেছিলেন। সাথে ছিলেন লাহোর ইউনিভার্সিটির উপাচার্য, স্কাউট এসোসিয়েশনের প্রধান, হাই স্কুল ও কলেজের শিক্ষা বোর্ডের প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্র-ছাত্রী। উনারা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরী ঐতিহ্য্যবাহী কাজী বাড়ীও পরিদর্শন করেন।
উনার নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকেও প্রতিনিধি দল পশ্চিম পাকিস্থানে গিয়েছিলেন। সিলেট জেলার হাতে গুনা প্রাচীন কয়েকটি সকুলের অন্যতম রিদ্যাপীঠের কৃতিত্ব ও সুনামে অবিভুত হয়ে ষাট দশকের প্রথম দিকে বেগম সুফিয়া কামাল ও নিলীমা ইব্রাহিমের মতো দেশের আরো অনেক কৃতি সন্তান এই স্কুল পরিদর্শন করেন।
অবসর গ্রহণের পরেও আজীবন কাশিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবৈতনিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে কাসিম আলী হাই স্কুলের আজীবন রেক্টর সম্মাননা দেয়া হয়।
শিক্ষা বিস্তারে অবদান: মরহুম ইনতাজির খান সাহেবের প্রচেষ্টায় ফেঞ্চুগঞ্জের কাসিম আলী সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সায়েন্স বিল্ডিং থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ সরকারী ডিগ্রি কলেজের যাত্রা শুরু হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর পিতা ইয়াহয়া চৌধুরীকে সাথে নিয়ে এ স্কুলেই কলেজ শুরু করেন। তাছাডা উনার অনুরোধে কলেজে ইংরেজির অবৈতনিক প্রভাষক হিসেবেও অধ্যাপনা করেন। বর্তমান জায়গায় কলেজ স্থানান্তরেও উনার বিশেষ অবদান ছিল। তিনি ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা সদস্য।
কাশিম আলী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বের পাশাপাশি মানিককোনা হাই স্কুল, পিপিএম হাই স্কুল, ঘিলাছড়া হাই স্কুলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূচনালগ্নে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন উদ্যোক্তা সদস্যদের অন্যতম। তাঁরই প্রচেষ্টায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের পর দুর্বার গণ আন্দলনের মাধ্যমে কেন্দ্রটি অন্য স্কুলে প্রতিস্থাপনে প্রতিপক্ষের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে সমর্থ হন। সেই স্মৃতিগুলো এখনও ফেঞ্চগঞ্জবাসীর মন থেকে মুছে যায়নি।
ফেঞ্চুগঞ্জ মোহাম্মদীয়া কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও ইন্তাজির খান ছিলেন অন্যতম। সার্বিক সহযোগীতার পাশাপাশি মোহাম্মদীয়া মাদ্রাসার ইংরেজি বিষয়ের অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবেও অবদান রাখেন।
সমাজ সেবায় অবদান: শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি সমাজসেবায়ও তাঁর অবদান মানুষ আজীবন স্মরণ করবে। ভারত-পাকিস্তান বিভাগের আন্দোলনে তিনি ১৯৪৭ সালে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রারম্ভিক সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা স্থাপনে সহযোগীতাসহ ফেঞ্চুগঞ্জের তৎকালীন অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অবকাঠামো গঠনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বন্ধ ও নিয়োগ বৈষম্যের আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পিপিএম হাই স্কুলের মাঠে সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসাবে আন্দোলনরত লাখো লোকের জনসভায় তিনি নেতৃত্ব দেন। যার ফলে সারকারখানা আজ স্থানীয় জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের শালিসী ব্যক্তিদের মধ্যমণি। তাঁর জীবদ্দশায় বড় এমন কোন শালিস বৈঠক নেই, যার প্রধানের দায়িত্ব উনি পালন করেননি। বিভিন্ন সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজের অনেক ছাত্র আন্দোলনের সুষ্ঠু সমাধানে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তাঁর কর্মজীবনে ফেঞ্চুগঞ্জ শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব অন্য কেউ পালন করেছেন বলে শোনা যায়নি। তৎকালীন ব্রিটিশ, পরবর্তী ইস্ট পাকিস্তানে রিভার ভিউ নামে একটি অফিসার্স ক্লাব ছিল (বর্তমানে বিলুপ্ত)। দীর্ঘ দিন তিনি ঐ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার জামে মসজিদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
তাঁর উদ্যোগে কাশিম আলী হাই স্কুলের ফিল্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর পৈত্রিক ভূমি ও নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে খরিদকৃত জায়গা স্কুলের নামে রেকর্ড করে গিয়েছেন। ফেঞ্চুগঞ্জ শাহী ঈদগাহ, ইসলামী পাঠাগার ইত্যাদির প্রতিষ্ঠিতা সদস্য ছিলেন তিনি।
খান সাহেব ১৯৮৮ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ১৯৮৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি পরলোক গমন করেন। এছাড়াও অনেক সামাজিক সংগঠনের সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে তিনি প্রথম বার পবিত্র হজব্রত পালন করেন।
মৃত্যু: ১৯৮৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে এ মহান জ্ঞানতাপস পরলোক গমন করেন। তাঁর জানাজায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতি ও দোয়া কর্মবীর আলহাজ ইন্তাজির খানের উন্নত জীবন যাপনের সাক্ষ্য বহন করে।
মরহুম ইনতাজীর খান শীক্ষাকে মানবতা ও সৌন্দর্যের ধারক হিসাবে মানতেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে কাজেও তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
বর্ণাঢ্য্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রয়াত ইন্তাজির খানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ সমাজের বিভিন্ন স্তরে উনার ছাত্র-ছাত্রীরা দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। ফেঞ্চুগঞ্জের স্বনামধন্য, অপেক্ষাকৃত প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত অনেক বিদ্যাপীঠের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে তাঁর নানামুখী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মরণোত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ফাউন্ডেশন পদক’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়।
তথ্যসূত্র: সাবেক ছাত্র ছাত্রী, বিভিন্ন মেগাজীন, বই ইত্যাদি থেকে সংকলিত।