শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

শিরোনাম

মহান মে দিবস ও শ্রমিকদের অধিকার

রবিবার, এপ্রিল ৩০, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
মো. গনি মিয়া বাবুল

মো. গনি মিয়া বাবুল: ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা বিশ্ব পরিমন্ডলে ‘মহান মে দিবস’ বা শ্রমিক দিবস হিসেবে গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। মে দিবস এলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ঘর্মাক্ত মেহনতি-শ্রমজীবী মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর এ শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিও সাথে সাথে উঠে আসে এ ঐতিহাসিক দিনে। এ দিবসের তাৎপর্য অনেক, এর পেছনে রয়েছে একটি রক্তস্নাত ইতিহাস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রম দিবস, মজুরী বৃদ্ধি, কাজের উন্নতর পরিবেশ ও শ্রমের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে আত্মহুতি দান করেছিলেন শ্রমিকরা, ১ মে বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট সমাবেশে পুলিশের গুলি বর্ষণে ছয়জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। এর প্রতিবাদে পর দিন হে মার্কেটে শ্রমিকরা মিলিত হলে কারখানার মালিকরা সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ও এতে চার শ্রমিক নিহত হয়। শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করার দায়ে অগস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষিত হয় ও তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে।

রাশিয়া ও পরবর্তী আরো কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন বা আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারগুলো স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও কতগুলো নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে এবং সব দেশের শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহ্বান জানায় এবং এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। বাংলাদেশে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, বিরোধীদলীয় নেতা ও সংশ্লিষ্ট শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে থাকেন। মে দিবসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র বা প্রবন্ধ কিংবা বিশেষ নিবন্ধন প্রকাশ করে। মাথায় রঙ-বেরঙের কাপড় বেধে নানা রঙের ফেস্টুনসহ শ্রমিকরা মিছিল শোভাযাত্রা বের করে, বেতার ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিশেষ অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সামাজিক -সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। দেশের সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এসব সভা-সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের খবর গুরুত্বসহকারে প্রচার করে থাকে। বাংলাদেশ মে দিবস পালনের ক্ষেত্রে মোটেও পিছিয়ে নেই। এ দেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হয়। তারপর পাকিস্তান আমলেও মে দিবস যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে হাজার হাজার শ্রমিক অংশ নেয় ও দেশ মাতৃকার জন্যে শহীদ হয়।

১৯৭২ সালে ১ মে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মে-কে সরকারি ছুটি ঘোষণা করাসহ রাষ্ট্রপতি আদেশ ২৭ (ক) ধারা মোতাবেক এ দেশের সব ব্যাংক, বীমা, শিল্প- কলকারখানা, রেল, নৌ-পরিবহনসহ বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ব ঘোষণা করেন। ফলে এর সুফলও ওই সব শিল্প কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীরা ভোগ করতে থাকেন। সরকার নীট মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে সমহারে বন্টনের ঘোষণা দেয়। ফলে, বেশ কিছু শিল্পে উৎপাদন ও মুনাফা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৯৭৭ সালে প্রথম পাকিস্তানী অবাঙালিদের রেখে যাওয়া কিছু কিছু শিল্প কলকারখানা ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া শুরু করেন। পরবর্তী জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার কম-বেশী সবাই ব্যক্তি মালিকানায় মিল কলকারখানা হস্তান্তর করেন। আটের দশকের শেষের দিকে পূর্ব-ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অতিদ্রুত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মসূচী পরিত্যাগ করে বাজার অর্থনীতি তথা মুক্তবাজার অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় পলিসি হিসেবে ঘোষণা করে।

এসব কারণে এক দিকে যেমন শোষণ-নির্যাতন বেড়েছে, অপর দিকে ব্যক্তির লুটপাটে পানির দামে ক্রয়কৃত চালু মিল কলকারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশ আজ আমদানি নির্ভর একটি সিন্ডিকেট চক্রের হাতে জিম্মি । বাংলাদেশে আজ শ্রমিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। নারী-পুরুষের মুজুরী বৈষম্যতো আছেই। এছাড়াও, প্রায় সব সেক্টরে আট ঘন্টার বেশী শ্রম দিতে হয়। হোটেল- রেস্তোরায় ও পরিবহন সেক্টরে ভোর ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শ্রমিক খাটানো হয়। তারপরও নেই কোন নিয়োগপত্র, নেই কোন মজুরী কাঠামো, নেই কোন উৎসব ভাতা কিংবা চিকিৎসা ভাতা। এসব সেক্টরে অধিকাংশ শিশু শ্রমিক নিয়োজিত আছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প , চাউলের কল, চাতাল, চিংড়ী ঘের ও কৃষি কাজে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিক কর্মরত আছে। এখানেও তাদের নেই কোন মজুরী কাঠামো বা নির্ধারিত শ্রম ঘন্টা অথবা কর্মের উপযুক্ত পরিবেশ। এমনকি শ্রমিকদের নেই নিজের জীবনের নূন্যতম নিরাপত্তা। অথচ তারাই নিজের শ্রম দিয়ে, ঘাম দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছেন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে শ্রমিক হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক নিহত ও দুই সহস্রাধিক শ্রমিক আহত হয়ে পঙ্গুবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাহ্যিকভাবে এটি দুর্ঘটনা। একটি ভবন ধসে লোক হতাহত হয়েছেন। আসলে এটা কি শুধুই দুর্ঘটনা? কথিত দুর্ঘটনার আগের দিন ভবনটিতে ভয়াবহ ফাটল দেখা যায়। লোকজন ভবন ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন ভবনে অবস্থিত কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনার আশংকায় খোলেনি। সেখানে গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করার জন্যে প্রায় চার হাজার শ্রমিককে চাকরির ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই ভবনের ভেতরে নেয়া হয়। তারপর এ দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবনটি বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করে সিলগালা করে বন্ধ করতে অসুবিধা কোথায় ছিল? ভবনটি নির্মাণে রাজউকের কোন অনুমোদন ছিল না। ভবন মালিক পৌরসভা থেকে ছয় তলা করার অনুমোদন নিয়ে, সেখানে নয় তলা ভবন তৈরি করল কিভাবে? এ ভবন ধসের বিষয়টি মানবসৃষ্ট। কাজেই এ বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি নিছক দুর্ঘটনা নয়, ইহা হত্যাকান্ড। ফলে, ভবন মালিক সোহেল রানাসহ দায়ী সব পোশাক শিল্পের মালিকদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী পোশাক শিল্পের মালিকদের বাঁচানোর যে চেষ্টা অতীতে বিজিএমইএ করে এসেছে, তা থেকে তারা সরে আসবে বলে আশা করছি। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতকে বাঁচানোর স্বার্থেই এটা করতে হবে। কর্মস্থলে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রানা প্লাজা হতাহত শ্রমিকদের অনেকেই আজো তাদের ক্ষতিপূরণ পায়নি।

এমনকি নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা শত চেষ্টা করেও খোঁজ কিংবা নিহত শ্রমিকের লাশও পায়নি। এ ভবন ধসের ঘটনার অভিজ্ঞতা নিয়ে অনুরূপ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি অন্যান্য কারখানায় না ঘটে, সে রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয় নি।
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-আন্দোলনে বাংলাদেশের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বাংলাদেশের শ্রম ক্ষেত্রে যত আইন, নীতি, বিধি-বিধান ও নীতিমালা রয়েছে, তা মূলত দেশের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা তথা শ্রমক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শ্রমিজীবী মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশী। সচেতন মহলের দাবি, দেশের টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক, কলাম লেখক, সমাজসেবক ও সংগঠক)
সভাপতি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, ঢাকা