বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

শিরোনাম

যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল একাডেমিসের কমিটিতে বাংলাদেশের বাহাউদ্দিন

বুধবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল একাডেমিস অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনের (ন্যাশনাল একাডেমিস–এনএএসইএম) একটি কমিটির সদস্য নির্বাচিত ও নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম।

বাহাউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইনের (ইউআইইউসি) দ্য গ্রেঞ্জার কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নিউক্লিয়ার, প্লাজমা অ্যান্ড রেডিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ইউআইইউসির ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, তিনি বিভাগটির দ্বিতীয় শিক্ষক, যিনি এ কমিটিতে নির্বাচিত ও নিযুক্ত হয়েছেন।

বাহাউদ্দিনের ঝুলিতে এ বছর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যোগ হয়েছে। তিনি ইউআইইউসির দ্য গ্রেঞ্জার কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ২০২৫ সালের ‘ডিনস অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ’ লাভ করেছেন।

গত জানুয়ারিতে এনএএসইএমের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) ‘ফাউন্ডেশন মডেলস ফর সায়েন্টিফিক ডিসকভারি অ্যান্ড ইনোভেশন: অপরচুনিটিস অ্যাক্রস দ্য ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন বাহাউদ্দিন। নির্বাচিত ও নিযুক্ত হওয়ার তথ্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুকে জানান তিনি। একই দিন ইউআইইউসির ওয়েবসাইটে এই নিযুক্তির খবর প্রকাশ করা হয়েছে। এনএএসইএমের ওয়েবসাইটে এ কমিটির তালিকায় ইতিমধ্যে বাহাউদ্দিনের নাম উঠেছে।

ন্যাশনাল একাডেমিসের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এ কমিটির দায়িত্ব হলো, জ্বালানিবিষয়ক গবেষণায় এআইভিত্তিক ফাউন্ডেশন মডেলের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অন্বেষণ করা। বিশেষ করে মার্কিন সরকারের জ্বালানি দপ্তরের (ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি) জন্য এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিয়ে কাজ করা। কমিটি এ বিষয়ে মার্কিন জ্বালানি দপ্তরের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে।

কমিটিতে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াসহ শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ-গবেষকেরা রয়েছেন।

বাহাউদ্দিনের ঝুলিতে এ বছর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যোগ হয়েছে। তিনি ইউআইইউসির দ্য গ্রেঞ্জার কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ২০২৫ সালের ‘ডিনস অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ ফর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর’ লাভ করেছেন। দ্য গ্রেঞ্জার কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধীন ১২টি প্রকৌশল বিভাগ আছে। প্রতিবছর ১২টি বিভাগ থেকে অসামান্য গবেষণার জন্য চার থেকে পাঁচজন সহকারী অধ্যাপককে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গত ৪ মার্চের ঘোষণা অনুযায়ী, এবারের এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাহাউদ্দিন।

বাহাউদ্দিন তাঁর এনার্জি-এআই নিয়ে বর্তমান গবেষণা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এআইয়ের বিকাশ ঘটিয়ে পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থায় (নিউক্লিয়ার এনার্জি সিস্টেম) পাইপ, কেব্‌ল, তাপমাত্রা- সব রিয়েল টাইমে (তাৎক্ষণিক) ঠিক আছে কি না, তা দেখছেন। নিউক্লিয়ার সিস্টেমে এআই, ডিজিটাল টুইন ও রিয়েল-টাইম প্রযুক্তির মাধ্যমে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার শনাক্ত করা যায়, যেগুলো সাধারণত দুর্গম বা সরাসরি পরিমাপযোগ্য নয়, কিন্তু মিলিসেকেন্ডের মধ্যে জানা সম্ভব।’

বাহাউদ্দিন চট্টগ্রামের ছেলে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেন। আর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

বাহাউদ্দিন ঝুঁকিমুক্ত পারমাণবিক শক্তির (নিউক্লিয়ার এনার্জি) বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। এনএএসইএমের কমিটিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তাঁকে জাতীয় নীতি ও গবেষণায় এআই ও এনার্জির সংযোগস্থলে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে দেবে বলে মনে করছেন তিনি।

শৈশবে ঘন ঘন বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের মুখোমুখি হওয়ায় বাহাউদ্দিনের মনে ‘এনার্জি’ সমস্যার সমাধানের তাগিদ জন্মায়। পরে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

বাহাউদ্দিন প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। সেখানে তিনি মেশিন লার্নিং অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ফর অ্যাডভান্সিং নিউক্লিয়ার সিস্টেম (মার্শান্স) নামের একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে অবস্থিত। গবেষণাগারটি মূলত ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি ও রিয়েল টাইম পূর্বাভাস অ্যালগরিদম নিয়ে কাজ করে। এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যাযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পূর্বাভাসমূলক রক্ষণাবেক্ষণ ও অনলাইন নিরীক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা।

২০১৯ সালের শেষ দিকে বাহাউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। সেখানে তাঁর পরিবারে আছেন দুই সন্তানসহ স্ত্রী তোহফাতুর রিদওয়ান। ছয় বছর বয়সী মেয়েসন্তানের নাম ইকরা সৈয়দা, আর এক বছর বয়সী ছেলেসন্তানটির নাম ইবাদ সৈয়দ।

বাংলাদেশে বাহাউদ্দিনের বাবা, মা ও ছোট বোন আছেন। বাহাউদ্দিন বলেন, ‘পরিবার, বিশেষ করে তাঁর এ পর্যায়ে আসার পেছনে স্ত্রী অনেক সহায়তা করেছেন। বাবা-মা-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি-শ্যালিকাসহ অন্যদের অবদানও অনস্বীকার্য। যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল। অন্যদিকে করোনা মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়াটাও কঠিন ছিল।’

বাহাউদ্দিন ঝুঁকিমুক্ত পারমাণবিক শক্তির (নিউক্লিয়ার এনার্জি) বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। এনএএসইএমের কমিটিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তাঁকে জাতীয় নীতি ও গবেষণায় এআই ও এনার্জির সংযোগস্থলে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে দেবে বলে মনে করছেন তিনি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে বাহাউদ্দিন বলেন, ‘শিশুকে যা শেখানো হবে, তাই শিখবে। খুব সহজভাবে বললে, এআইও অনেকটা তেমনি। এটিকে যেভাবে ব্যবহার করা হবে, সেভাবেই কাজ করবে। এআই প্রযুক্তি নিয়ে অনেক মানুষের মনে একধরনের আতঙ্কও কাজ করছে। তবে এটা বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন পর্যন্ত মানুষের হাতেই আছে, থাকবে।’

বাহাউদ্দিন বলেন, ‘আমার রিসার্চ গ্রুপের গবেষণায় আমরা একটি নতুন পদ্ধতি প্রস্তাব করেছি। যা পরমাণুশক্তি ব্যবস্থাগুলোকে নিরাপদ রাখতে অত্যাধুনিক মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। সাধারণত পারমাণবিক চুল্লির ভেতরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার পরিমাপ করা খুবই কঠিন। কারণ, সেগুলো অনেক সময় চরম প্রতিকূল পরিবেশে থাকে। আমাদের ডিজিটাল টুইন পদ্ধতিতে আমরা ভার্চ্যুয়াল সেন্সরের সাহায্যে তাপমাত্রা ও তাপমাত্রাপ্রবাহ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার পূর্বাভাস দিতে পারি, যা প্রচলিত কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডায়নামিকস সিমুলেশনের তুলনায় প্রায় ১ হাজার গুণ দ্রুত ফলাফল দিতে সক্ষম। যেটা আগের মতো প্রতিটি স্থানে ফিজিক্যাল সেন্সর বসানোর প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়।’

বাহাউদ্দিন জানালেন, তাঁর রিসার্চ গ্রুপের পিএইচডি গবেষক কাজুমা কোবায়াশি, ফরিদ আহমেদ, সমরেন্দ্র রয় ও ট্রেভর তালবট বর্তমানে এই গবেষণায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাহাউদ্দিন বলেন, ‘ভাবুন, যেন আমাদের হাতে চুল্লির একটি ভার্চ্যুয়াল মানচিত্র আছে। যেটা থেকে আমরা রিয়েল টাইমে ফিডব্যাক পাচ্ছি। যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় সেন্সর বসাতে হচ্ছে না। এতে শুধু পর্যবেক্ষণের গতি বাড়ে না, যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতাও অনেক বেড়ে যায়। ফলে সম্ভাব্য সমস্যাগুলোকে আগেভাগেই শনাক্ত করা যায়। যা নিরাপত্তা ও দক্ষতা—উভয় দিক থেকেই বিশাল অগ্রগতি। এবং আমরা এটা নিয়ে কাজ করে চলেছি। এআই মানুষের তত্ত্বাবধানকে প্রতিস্থাপন করছে না। বরং এটি সিস্টেমের বিভিন্ন উপাদানের সম্ভাব্য ত্রুটি বা ব্যর্থতা আগেভাগেই নির্ণয় ও পর্যবেক্ষণের নতুন পথ তৈরি করছে।’

বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজের অনেক সুযোগ আছে, নানান কাজ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন বাহাউদ্দিন।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জ্বালানি খাতে এএআই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।